৩০ লাখ শহীদ পরিবারের জন্য কোটা কোথায়

রফিউর রাব্বি: 

আমরা বলে থাকি, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদ হয়েছেন, ২ লাখ মা-বোন সম্ভ্রম হারিয়েছেন। আহত হওয়ার সংখ্যা শহীদের চেয়েও অনেক বেশি। লাখ লাখ মানুষের ঘরবাড়ি পুড়েছে, সহায়-সম্বল হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন অসংখ্য মানুষ। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দেওয়ার কারণে হাজার হাজার মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে কোন অংশের অবদান কতটুকু বা কারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, সে হিসাব বা জরিপ কখনো কোনো সরকার করেনি।

যে মানুষটি শহীদ হলেন, তাঁকে হারিয়ে তাঁর পরিবার কতটা কঠিন অবস্থার মধ্য দিয়ে টিকে থাকার প্রাণপণ লড়াই করেছে, তার হিসাব যেমন নেই। অর্ধশতাব্দী চলে গেলেও শহীদের নামের তালিকা তৈরি করারও উদ্যোগ কোনো সরকার নেয়নি।

যাঁরা সম্ভ্রম হারিয়েছেন, পরিবার তাঁদের গ্রহণ করেনি, সমাজ গ্রহণ করেনি। তাঁদের অনেকের আত্মহত্যার কথা আমরা জানি। কিন্তু যাঁরা বেঁচে থেকেও মরে পড়ে রইলেন রাষ্ট্রের অবহেলা আর উদাসীনতায়, তাঁদের তালিকা বা তথ্যটিই-বা কই? যাঁরা সর্বস্ব খুইয়েছেন, তাঁদেরও কোনো হিসাব নেই। মুক্তিযুদ্ধে কোনো না কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, এমন মানুষের সংখ্যা দেশে ৯০ শতাংশের কম নয়।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এ কাজগুলো করার দায়িত্বে থাকলেও তারা তা করেনি। তারা রাজাকারের তালিকাটা পর্যন্ত তৈরি করতে পারেনি। অনেক রাজাকার, স্বাধীনতাবিরোধী যে তাদের দলে ঢুকে পড়েছেন বলেও সমালোচনা আছে।

গত ১৫ বছর ধরে বর্তমান সরকার একটি নির্ভুল বীর মুক্তিযোদ্ধার তালিকা তৈরি করতে পারেনি। আমরা জানছি, তালিকাভুক্ত হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধার জন্ম ১৯৭১-এর পরে। আবার প্রায় সাড়ে তিন হাজার মুক্তিযোদ্ধাকে উচ্চ আদালতের রায় নিয়ে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি আদায় করতে হয়েছে।

একদিকে দলীয় বিবেচনায় বা অর্থের বিনিময়ে যেমনি অনেকে মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়েছেন, অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেও অসংখ্য বীর মুক্তিযোদ্ধা সনদ গ্রহণ করেননি। বিশেষ করে গ্রামের কৃষক-সন্তান, প্রান্তিক যে জনগোষ্ঠী যুদ্ধে গেছেন, তাঁদের অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধা সনদ নেননি।

সরকার বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আর্থিক বিভিন্ন সুবিধা দিচ্ছে, মহান স্বাধীনতা দিবস বা বিজয় দিবসে মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনাসহ বিভিন্ন আয়োজন করছে। কিন্তু সে আয়োজনে বা সরকারের কোনো পরিকল্পনায় শহীদ পরিবার, নারী বীর মুক্তিযোদ্ধার বা যুদ্ধে সর্বস্বহারা পরিবারের কোনো স্থান নেই।

সংগত কারণেই প্রশ্ন ওঠে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধে কাদের অবদান কতটুকু? ৫৩ বছর পরে সে হিসাবটা তো মেলাতে হবে। কিন্তু স্বাধীনতা-উত্তর কোনো সরকার এ প্রশ্নের মুখোমুখি হতে চায়নি, বরং একে নিয়ে রাজনীতি করাতেই নিজেদের স্বার্থ দেখেছে।

আজকে কোটাপদ্ধতি নিয়ে বিতর্কের কারণে আবারও সে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। আমাদের সংবিধানের ২৯ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ–লাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকিবে।’ ২৮(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, বাসস্থান বা পেশাগত কারণে কোন নাগরিকের প্রতি বৈষম্য করা যাবে না।’ আজকের এই কোটাপদ্ধতিটি আমাদের সংবিধানের সঙ্গে কেবল সাংঘর্ষিকই নয়, তা মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষারও পরিপন্থী।

মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সম্মানের কথা বলে এই কোটাপদ্ধতি শহীদ পরিবার, নারী বীর মুক্তিযোদ্ধা পরিবার বা মুক্তিযুদ্ধে সর্বস্বহারা পরিবারের স্বার্থবিরোধী একটি পদ্ধতি। কারণ এসব পরিবারের মেধাবী সন্তানেরা এই কোটাপদ্ধতির কারণে বৈষম্যের শিকার হবেন। এই কোটাপদ্ধতিতে কেবল সনদধারী বীর মুক্তিযোদ্ধা পরিবারকেই উপলক্ষ করা হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধে অন্য সব ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার এখানে উপেক্ষিতই শুধু নয়, রাষ্ট্রীয় বৈষম্যের শিকার।

মেধাবীদের বাদ দিয়ে দলীয় বিবেচনায় রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় কোটার মাধ্যমে বসালে মেধাবীদের প্রতি বৈষম্য শুধু নয়, তা যে রাষ্ট্রে কী ভয়াবহ পরিণতি বয়ে আনে, এটি আমরা বর্তমান দুর্নীতির দিকে তাকালে বুঝতে পারি।

দেশি ও বিদেশি বিভিন্ন গবেষণাপ্রতিষ্ঠান বলছে, বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষিত বেকার এখন ৪৭ শতাংশ। তরুণ-যুবকেরা দেশ ছেড়ে দলে দলে পালাতে চাইছেন। বেকারত্বের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে কেউ কেউ সাগর পাড়ি দিচ্ছেন, কেউবা আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন। সরকারের উদাসীনতা ও ভুল নীতি আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অন্ধকারে ঠেলে দিচ্ছে। সরকার মুক্তিযুদ্ধের বায়বীয় তত্ত্ব হাজির করে কার্যত মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। বিষয়টি ইচ্ছাকৃতভাবে আদালতের দিকে ঠেলে দিয়েছে।

কোটা ফিরিয়ে আনা হলে বা সংস্কার করা না হলে দেশ ও সমাজের ভারসাম্য নষ্ট তো হবেই, বৈষম্যও বৃদ্ধি পাবে। অন্যদিকে সেটি হবে সংবিধানের লঙ্ঘনও। সরকার যদি তা উপলব্ধি করতে না পারে এ সংকট আরও বাড়বে এবং এর পরিণতি হবে কোনো অর্থেই ভালো হবে না।


রফিউর রাব্বি

লেখক ও সাংস্কৃতিক সংগঠক

সংগৃহিত: প্রথম আলো