সাবরিনা রহস্যের আদ্যোপান্ত: যখন যেভাবে যা হয়েছিল

ঘটনার আড়ালে যেমন ঘটনা থাকে তেমনই খালি চোখে দেখা সত্যের গভীরেও থাকে আরও গভীর সত্য। ঘটনার অতলে ডুব দিলেই সেই গভীর সত্যকে স্পর্শ করা যায়। দেখা যায় ঘটনার ইতি-নেতি। বিচার করা যায় সেই ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তির দোষ-গুণ অথবা ভূমিকা।

করোনার ভাইরাসের পরীক্ষা জালিয়াতি নিয়ে তেমনই এক মহাদুর্নীতির ঘটনার জানাজানির শুরুটা হয়েছিল গত ২৩ জুন। আর সেটা হয়েছিল জোবেদা খাতুন হেলথ কেয়ার (জেকেজি) থেকে চাকুরিচ্যুত এক দম্পতিকে গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে। ওই দম্পতি হলেন জেকেজির নার্স তানজিনা পাটোয়ারী ও তার স্বামী জেকেজির গ্রাফিক্স ডিজাইনার হুমায়ূন কবির হিরু। তাদের গ্রেফতারের পর দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে ওইদিন গ্রেফতার করা হয়েছিল জেকেজির প্রধান নির্বাহী আরিফুল হক চৌধুরীকে। ঠিক এখান থেকেই জমে উঠে জেকেজির করোনা জালিয়াতির গল্পটা।

স্বামী আরিফুল হক চৌধুরীকে গ্রেফতারের পর গেল কিছুদিন ধরেই নিজেকে রক্ষায় প্রভাবশালী মহলে দৌড়ঝাঁপ করছিলেন ডা. সাবরিনা শারমিন হুসাইন ওরফে সাবরিনা আরিফ চৌধুরী। কিন্তু কিছুতেই শেষরক্ষা হলো না। করোনা ভাইরাসের পরীক্ষা নিয়ে জেকেজি হেলথকেয়ারের রিপোর্ট জালিয়াতির ঘটনায় গত রবিবার পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদের পর গ্রেফতার হন জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউটের চিকিৎসক ও জেকেজির চেয়ারম্যান ডা. সাবরিনা।

তবে তার আগেই গত কয়েকদিন ধরে সামাজিকমাধ্যমে সাবরিনার ছবি পোস্ট করে ট্রল হচ্ছে। তিনি কতটা সুন্দর, দেখতে কতটা আকর্ষণীয়, কবে সিনেমার নায়িকা হওয়ার জন্য কোন পরিচালকের বাসায় গিয়েছিলেন, তার স্বামী কয়টা, কবে কোনও পুরুষের সঙ্গে ঘুরতে গিয়েছিলেন- সোস্যাল মিডিয়ায় এ নিয়ে মাতামাতির কোনও শেষ নেই। বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরেও উঠে আসছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। ডা. সাবরিনার একান্ত ব্যক্তিগত জীবনের অজানা নানা খবর।

আরিফ চৌধুরীর সঙ্গেই প্রথম নয়, জানা যায়- এর আগেও একবার বিয়ে হয়েছিল ডা. সাবরিনার। প্রথম সংসারে তার দুই সন্তান আছে। তবে জিকেজির প্রধান নির্বাহী আরিফ চৌধুরীকে বিয়ে করার পর তাদের কোনও সন্তান হয়নি।

সূত্রের খবরে জানা যায়, স্বামী-স্ত্রী মিলে করোনা টেস্ট জালিয়াতি করলেও তাদের দাম্পত্য জীবন সুখের ছিল না। স্ত্রীর সঙ্গে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের এক চিকিৎসককে আপত্তিকর অবস্থায় দেখে ফেলায় ওই চিকিৎসককে মারধর করেন আরিফ চৌধুরী।

পরে এ ঘটনায় স্বামীর বিরুদ্ধে শেরেবাংলা নগর থানায় ডিজি করেছিলেন ডা. সাবরিনা। এছাড়াও জেকেজির এই কর্মীকে অশালীন প্রস্তাব দেয়ায় গুলশান থানায় আরিফ চৌধুরীর বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে।

নার্স তানজিনা পাটোয়ারী ও তার স্বামী হুমায়ূন কবির জেকেজিতে চাকরি করতেন। তানজিনার বেতন ছিল ৩০ হাজার টাকা। ভুয়া করোনা পরীক্ষা করে কোটি কোটি টাকা কামানো দেখে তানজিনাও তার বেতন বাড়ানোর দাবি করেন। বিষয়টি জানার পর জেকেজির কর্ণধার আরিফ চৌধুরী তানজিনা ও তার স্বামী হুমায়ূন কবিরকে চাকরিচ্যুত করেন। পরে এই দম্পতি বাসায় বসে নিজেরাই করোনার ভুয়া টেস্ট বাণিজ্য শুরু করেন। তানজিনা ঘুরে ঘুরে নমুনা সংগ্রহ করতেন আর হুমায়ূন বাসায় বসে ভুয়া রিপোর্ট তৈরি করতেন।

গত ২৩ জুন রাতে তানজিনা ও তার স্বামী গ্রেফতার হওয়ার পর থলের বেড়াল বেরিয়ে আসতে শুরু করে। ফাঁস হয়ে যায় জেকেজির করোনা জালিয়াতির মূল রহস্য। এরপরই গত ২৩ জুন রাতেই জেকেজির গুলশান অফিসে অভিযান চালায় তেজগাঁও থানা পুলিশ। অভিযানে গ্রেফতার করা হয় প্রতারণার মূল হোতা ও জেকেজির প্রধান নির্বাহী আরিফ চৌধুরীসহ ৬ জন। তবে শুরু থেকেই ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিলেন ডা. সাবরিনা। অনেকেই ভেবেছিলেন, চিকিৎসক সংগঠনের প্রভাবশালী নেতার প্রিয় বান্ধবী হওয়ায় হয়তো সাবরিনাকে গ্রেফতার করা হবে না। হয়তো তিনি অধরাই থেকে যাবেন। ওই রাতেই জেকেজির কিছু কর্মী তেজগাঁও থানার সামনে জড়ো হয়ে হট্টগোল শুরু করেন এবং আরিফ চৌধুরীকে ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করেন। এ ঘটনায় করা পৃথক মামলায় এ পর্যন্ত ১৮ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।

স্বামীকে গ্রেফতারের পর থেকেই নিজেকে বাঁচাতে মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন ডা. সাবরিনা। চিকিৎসক নেতা থেকে শুরু করে প্রভাবশালীদের অন্দরমহলে ধর্ণা দেয়া শুরু করেন। জেকেজির সঙ্গে কোনও সম্পৃক্ততা নেই জানিয়ে গত ২৪ জুন ভোর সোয়া ৫টার দিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন তিনি। সেখানে লিখেন- “অনেক আশা নিয়েই জেকেজি হেলথকেয়ার শুরু করেছিলাম বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা দেয়ার জন্য!!! কোনও জিনিস প্রতিষ্ঠা করাই বড্ড কঠিন! অনেক কষ্ট করেছি! করোনা বিপর্যয় শুরু হওয়ার পর প্রথম এলাকাভিত্তিক স্যাম্পল কালেকশন শুরু হয়। কত মানুষের কত রকম বাধা! কোনও দোকান খোলা নেই, জিনিসপত্র নেই, কেউ ভয়ে করোনা নিয়ে কাজ করতে চায় না! সব পেরিয়ে পথ চলা!!!

কিন্তু সেই প্রতিষ্ঠান থেকেই আমাকে সরে আসতে হয়! যারা আমাকে কাছ থেকে চেনেন, তারা জানেন– আদর্শ আর ভালোবাসার কনফ্লিক্টে আমি সবসময় আদর্শকেই বেছে নিয়েছি! ৪-৬ তারিখেই স্বাস্থ্য অধিদফতর আর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন অ্যান্ড রেফারেল সেন্টার ল্যাবের অধ্যাপক তুষার স্যার এবং আমার কাছে যে কজন সাংবাদিক ভাই ও বোনের নম্বর ছিল তাদের জানিয়ে আমি সরে যাই এখান থেকে! আমি চলে গেছি মানে এই নয় যে, এখানকার কোনো সমস্যায় আমি পুলকিত হব বা তা আমাকে ছোঁবে না! যদি কেউ দোষ করে থাকে, তার প্রমাণ সাপেক্ষে অবশ্যই সাজা হবে! হওয়াই উচিত! তবে আমার প্রশ্ন হলো– দুয়েকজন কর্মচারীর নামে অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে একটা প্রতিষ্ঠান যে এতদিন ধরে সেবা দিয়ে গেছে সব মুহূর্তেই মিথ্যা হয়ে যাবে?

আমার বেশিরভাগ এফবি ফ্রেন্ড আমার জন্য উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছেন, ভরসা দিয়েছেন- তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা! যারা চিরকালই আমার দোষ বের করতে পেরে বিমল আনন্দ পেয়েছেন, তাদের জন্য এই পোস্ট নয়…।”

দীর্ঘ এই স্ট্যাটাসেও তার ওপর থেকে সন্দেহ যায়নি আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর। গত রবিবার ঢাকা মহানগর পুলিশের তেজগাঁও বিভাগীয় উপকমিশনারে (ডিসি) কার্যালয়ে ভুয়া সার্টিফিকেট দেয়াসহ নানা বিষয়ে ডা. সাবরিনাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন তেজগাঁও বিভাগের ডিসি মোহাম্মদ হারুন অর রশিদ। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়। এরইমধ্যে পুলিশ বাদী হয়ে একটি মামলাও করেছে।

গত রবিবার সরকারি কর্মচারী বিধিমালা ভঙ্গের অভিযোগে ডা. সাবরিনাকে সাময়িক বরখাস্ত করার কথা জানায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।

অন্যদিকে করোনা পরীক্ষা নিয়ে জালিয়াতির অভিযোগে গুলশান থানায় এক ভুক্তভোগীর করা মামলায় গ্রেফতার হয়ে কারাগারে আছেন সাবরিনার স্বামী আরিফুল হক চৌধুরীও।

করোনা ভাইরাসের পরীক্ষা নিয়ে রিপোর্ট জালিয়াতির মামলায় জেকেজি হেলথকেয়ারের চেয়ারম্যান ও জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউটের চিকিৎসক ডা. সাবরিনা শারমিন হুসাইন ওরফে সাবরিনা আরিফ চৌধুরীর ৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। গতকাল সোমবার তেজগাঁও থানা পুলিশের ৪ দিনের রিমান্ড আবেদনের প্রেক্ষিতে ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট শাহিনুর রহমান এ আদেশ দেন।

সৈয়দ মোশাররফ হুসাইন নামে এক সাবেক আমলার মেয়ে সাবরিনা পড়ালেখা করেছেন সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে। ২৭তম বিসিএসে তিনি সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। ডা. সাবরিনা জেকেজির প্রধান নির্বাহী আরিফ চৌধুরীর চতুর্থ স্ত্রী। পারিবারিক নাম সাবরিনা শারমিন হুসাইন হলেও তিনি ডা. সাবরিনা আরিফ নামেই পরিচিত।

তবে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে ডা. সাবরিনা দাবি করেন, দুই মাস আগে আরিফ চৌধুরীর সঙ্গে তার তালাক হয়ে গেছে। এখন তাদের মধ্যে কোনও সম্পর্ক নেই। আরিফ চৌধুরীর এক স্ত্রী লন্ডনে, একজন রাশিয়ায় থাকেন। অপর স্ত্রীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হলেও সমঝোতার জন্য ওই স্ত্রী এখনও উপর মহলে দৌড়াদৌড়ি করছেন বলে জানা গেছে।

এদিকে ডা. সাবরিনার ঘনিষ্ঠজন সূত্র জানিয়েছে, রাজধানীর মোহাম্মদপুরে রনি নামে সাবরিনার এক ব্যবসায়ী বন্ধু থাকেন। মাঝেমধ্যেই নিজে গাড়ি চালিয়ে রনির বাসায় যেতেন ডা. সাবরিনা। তাদের মধ্যে বেশ সখ্যতাও ছিল।

তেজগাঁও পুলিশের করা অভিযোগে জানা যায়, ডা. সাবরিনা যে মোবাইল সিমটি ব্যবহার করছেন সেটি এক রোগীর নামে নিবন্ধন করা। পুলিশ বলছে, এটিও একটি বড় অপরাধ। এ বিষয়ে সাবরিনা কিছু জানতেন না বলে সাংবাদিদের জানান।

এদিকে করোনা ভাইরাসের পরীক্ষা জালিয়াতির ঘটনার অন্যতম হোতা রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক ও রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান মো. শাহেদ এবং জেকেজি হেলথকেয়ারের চেয়ারম্যান ডা. সাবরিনা আরিফের ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। তাদের নামে থাকা ব্যাংক হিসাবের সব তথ্য চেয়ে তফসিলি ব্যাংকগুলোকে চিঠি দেয়া হয়েছে।

এনবিআরের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেল (সিআইসি) গত রবিবার বিকেলে শাহেদ ও সাবরিনার ব্যাংক হিসাব জব্দ করার জন্য সব ব্যাংককে চিঠি দেয়। আর ব্যাংক হিসাবের সব তথ্য ৭ দিনের মধ্যে পাঠাতে বলা হয়েছে। শুধু শাহেদ-সাবরিনাই নয়, জব্দ করা হয়েছে ডা. সাবরিনার স্বামী জেকেজির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আরিফুল হক চৌধুরী ও রিজেন্ট হাসপাতালের পরিচালক ইব্রাহিম খলিলের ব্যাংক হিসাবও। 

error: কাজ হবি নানে ভাই। কপি-টপি বন্ধ