করোনার মধ্যেও দেশের অন্যতম আলোচনার নাম ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মানিকগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) ও সাবেক ক্রিকেটার নাঈমুর রহমান দুর্জয়।
চাকরির প্রলোভন দিয়ে এলাকার অভাবী মানুষের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়াসহ নানা খাতে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে দুর্জয়ের বিরুদ্ধে। তবে এখনো বহাল তবিয়তেই আছেন তিনি। নানা অনিয়ম করে অবৈধ সম্পদ অর্জনকারী দুর্জয়ের ব্যাপারে যেন নীরব দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
অবৈধ সম্পদ অর্জনকারীদের সুখে থাকতে দেবে না দুদক গত ৯ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবসে এই হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছিলেন দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ। কিন্তু দুর্জয়ের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় মানিকগঞ্জ এলাকার লোক তার খুঁটির জোর নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তারা বলছেন, দুর্জয় টানা দুবার এমপি হয়ে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। স্ত্রী ফারহানা রহমান হ্যাপীর নামেও গড়ে তুলেছেন সম্পদের পাহাড়। এ নিয়ে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারাও ক্ষুব্ধ। এসব কর্মকা-ে সাবেক এই ক্রিকেটারের জনপ্রিয়তা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগের কোনো কোনো নেতা।
মানিকগঞ্জের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দুর্জয়ের নির্বাচনী এলাকার অসংখ্য বেকার যুবক বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চাকরির আশায় সর্বস্ব খুইয়েছেন। এজন্য তারা এমপি দুর্জয়ের পেছনে মাসের পর মাস ধরনা দিয়েছেন, চাকরবাকরের মতো ফুটফরমায়েশ খেটেছেন, পাশাপাশি চাকরি নিশ্চিত করতে এমপির ঘনিষ্ঠদের হাতে তুলে দিয়েছেন লাখ লাখ টাকা। কিন্তু শেষমেশ তাদের কারোই ভাগ্যে চাকরি জোটেনি, ফেরত পাননি টাকাও। ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষজন চড়া সুদে আনা টাকা ফেরত দিতে ব্যর্থ হয়ে প্রতি মাসে সুদ গুনতে বাধ্য হচ্ছেন। চাকরির আশায় এমপির বাসায় টাকা দিয়ে প্রতারণার শিকার হয়েছেন দলীয় নেতাকর্মীরাও।
মানিকগঞ্জের দৌলতপুরের চরকাটারী ইউনিয়ন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক আবু বকর সিদ্দিক দলীয় পদবি ব্যবহার করে কোথাও প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করেননি। টেন্ডারবাজি-চাঁদাবাজির সঙ্গেও জড়িত নন তিনি। অভাবী পরিবারের সন্তান আবু বকর সিদ্দিক স্বপ্ন দেখেন ছোট একটি চাকরির। কিন্তু চাকরি তো হয়ই-নি, উল্টো স্থানীয় এমপি দুর্জয়ের নামে তারই ভাগ্নে আব্বাস ‘ঘুষ বাবদ’ হাতিয়ে নিয়েছেন পাঁচ লাখ টাকা। সে টাকার বিপরীতে গত প্রায় আড়াই বছর ধরে সুদের ঘানি টানছে তার পরিবার। তিনি বলেন, ‘টাকা ফেরত না পেয়ে আমি এমপি (দুর্জয়) সাহেবের সঙ্গে ঢাকায় তার লালমাটিয়ার বাসায় দেখা করি। একপর্যায়ে তিনি আমাকে বলেছেন আরও কিছুদিন ধৈর্য ধর। আবার সার্কুলার দিলে তোর চাকরি হয়ে যাবে।’ আবু বকর সিদ্দিক বলেন, ‘কিন্তু সে চাকরি জোটেনি আজও।’ একই উপজেলার লাউতারা গ্রামের প্রয়াত মহির উদ্দিনের ছেলে আবদুল আজিজও এমপি চক্রের ‘চাকরি বাণিজ্যের’ শিকার। স্কুলে পিয়নের চাকরির জন্য তাকেও খোয়াতে হয়েছে ১৪ শতাংশ জমির ওপর গড়ে তোলা একটি বাগান এবং এনজিও থেকে নেওয়া ঋণের পুরোটাই।
আজিজ বলেন, ‘পিয়ন পদের জন্য ঘুষ বাবদ ছয় লাখ টাকা এমপির ঘনিষ্ঠ আব্বাসের কাছে পৌঁছে দিই। কিন্তু ভাগ্যে জোটেনি চাকরি, ফেরত পাইনি টাকাও। এদিকে এনজিওর কিস্তি বাবদ প্রতি সপ্তাহেই হাজার টাকা গুনতে হচ্ছে, অন্যদিকে ঋণ বাবদ পৌঁছাতে হচ্ছে চড়া সুদ। পরিবারের সদস্যদের মুখে দুই বেলা দুই মুঠো খাবার তুলে দেওয়াই এখন কষ্টকর।’
এসব অভিযোগের ব্যাপারে জানতে দুর্জয়ের ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও সাড়া পাওয়া যায়নি।
খোঁজ নিয়ে আরও জানা গেছে, দুর্জয় ২০১৪ সালে এমপি হওয়ার পরপরই বাড়তে থাকে তার সম্পদ। রাতারাতি একটি পাওয়ার প্লান্টের পরিচালক বনে যান। দুর্জয় ২০১৮ সালের নির্বাচনের হলফনামায় নিজেকে চেজ ট্রেডিং লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও চেজ পাওয়ার লিমিটেডের পরিচালক হিসেবে উল্লেখ করেন। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে তিনি যে হলফনামা দাখিল করেন সেখানে তার পেশার বিবরণীতে পাওয়ার প্লান্টের পরিচালক পদটি ছিল না। সেখানে দুর্জয় যে দুটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত বলে উল্লেখ করে তাতে পাওয়ার প্লান্টের নাম ছিল না। ২০১৮ সালে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সময় তিনি বছরে আয় দেখান ৪৩ লাখ ৭৫ হাজার ২শ টাকা। এর মধ্যে কৃষি খাত থেকে ৫২ হাজার ৮শ, পারিতোষিক ও ভাতাদি থেকে আয় ২৩ লাখ ৪শ এবং মৎস্য চাষ থেকে আয় দেখিয়েছেন ১৯ লাখ ৮০ হাজার। এই হলফনামা দেওয়ার পাঁচ বছর আগের নির্বাচনের সময় তিনি বছরে আয় দেখান ৫ লাখ ৭০ হাজার। যেখানে কৃষি খাতে এক লাখ এবং ব্যবসা থেকে ৪ লাখ ৭০ হাজার টাকা আয় ছিল তার। অর্থাৎ প্রথমবার এমপি হওয়ার পর ৫ বছরে আয় বাড়ে ৭ দশমিক ৬৮ গুণ।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, দুর্জয়ের ক্যাডার বাহিনীর ভয়ে কেউ মুখ খুলতে পারে না। দুর্জয় বাহিনীর জমি দখলের বিষয়টি এলাকায় এখন ‘ওপেন সিক্রেট’। ওই এলাকায় দখলভীতির কারণে জেলার বাইরে থেকে কোনো ব্যক্তি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের জন্য জমি কিনতে আসে না। সে কারণে ওই এলাকায় জমি কেনাবেচাও খুব কম।
এত সম্পদ আর দুর্নীতির অভিযোগ যার বিরুদ্ধে সেই দুর্জয়ের বিরুদ্ধে কোনো মামলা নেই দুদকে। ক্যাসিনো কা-ে দুদকের ভূমিকা সব মহলে প্রশংসিত হয়েছে। কিন্তু দুর্জয়ের ব্যাপারে অজানা কারণে নিশ্চুপ হয়ে আছে দুদক। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে দুদক সচিব মুহাম্মদ দিলোয়ার বখত বলেন, ‘দুর্জয়ের বিরুদ্ধে দুদকে কোনো মামলা নেই। বিভিন্ন গণমাধ্যমে তার বিরুদ্ধে যেসব খবর বেরিয়েছে সেগুলো কমিশন গোপনে যাচাই-বাছাই করবে। অনুসন্ধানযোগ্য হলে দুদক অবশ্যই ব্যবস্থা নেবে।’
উৎসঃ দেশ রুপান্তর