মার্কিন টেলিভিশন- এনবিসির সান্ধ্যকালীন তথা প্রাইমটাইমে এই প্রোগ্রামের শুরুতে বড় পর্দায় একের পর এক তিনটি ছবি ভেসে উঠল : স্যার আইজাক নিউটন, অ্যালবার্ট আইনস্টাইন, এবং স্টিফেন হকিং …তারপর এক মুহূর্ত নীরবতা। কে হতে যাচ্ছে আমাদের সময়ের নিউটন, আইনস্টাইন বা হকিং ? সে কি ব্রিটিশ? জার্মান? নাকি আমেরিকান? আমেরিকানদের কৌতূহলটি শেষ হয় যখন সাদা শার্ট এবং বো টাই পরা এক বাঙালি বংশোদ্ভূত আমেরিকান শিশু হলিউড কিংবদন্তি মেলিসা ম্যাকার্থির সাথে মঞ্চে আসে! পুরো স্ক্রিনে ভেসে উঠে তার নাম ‘সুবর্ণ আইজ্যাক বারী’। কানাঘুষা শুরু হয়! কে এই সুবর্ণ?
সুবর্ণ বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত। তার জন্ম ২০১২ সালের ৯ এপ্রিল- নিউইয়র্কের একটি বাংলাদেশি বাঙালি পরিবারে! খুব অল্প বয়সেই বিশ্বে তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে পিএইচডি পর্যায়ের গণিত, পদার্থবিজ্ঞান এবং রসায়নের সমস্যাগুলো সমাধান করতে সক্ষম হওয়ার জন্য।
সাত সাগর তের নদী দূর থেকেই বাংলাদেশকেই যেন তুলে ধরলে মাত্র আট বছরের শিশু সুবর্ণ। গত ৮ মার্চ আমেরিকানরা শীর্ষস্থানীয় এনবিসি টিভির একটি জনপ্রিয় টক-শো (টেলেন্ট হান্ট) ‘লিটল বিগ শট’-এ বাংলাদেশকে নতুনভাবে চিনল।
বছর চারেক আগে বিশ্বের সবচেয়ে মেধাবী হিসেবে স্বীকৃত ৩০ হাজার শিশু তালিকাভুক্ত করে এনবিসি। নানাভাবে এদের সাথে কথা বলে, সাক্ষাৎকার গ্রহণের পাশাপাশি লিখিত পরীক্ষাও নেয়া হয়। এরপর বেছে নেয়া হয়েছে ২০ জনকে। তারই একজন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এই সুবর্ণ। নিউইয়র্ক সিটির ব্রঙ্কসে মা-বাবার সাথে বাস করছেন সুবর্ণ। তার বাবা রাশিদুল বারি এখানকার একটি ইউনিভার্সিটির শিক্ষক।
সুবর্ণ মাত্র ৬ বছর বয়সে অর্থাৎ ২০১৮ সালে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্বীকৃতি পেয়েছে বিজ্ঞানী হিসেবে। নোবেল বিজয়ী কৈলাস সত্যার্থীতাকে দিল্লিতে ‘গ্লোবাল চাইল্ড প্রোডিজি অ্যাওয়ার্ড’ দেন বিজ্ঞানী হিসেবে। রুইয়া কলেজ অব মুম্বাই বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ভিজিটিং অধ্যাপক হিসাবে নিয়োগ দিয়েছে পদার্থবিজ্ঞানী হিসেবে। সবচেয়ে বড় কথা ২০১৪ সালে নিউইয়র্ক সিটি কলেজের প্রেসিডেন্ট ড. লিসা কোইকো সুবর্ণকে ‘আমাদের সময়ের আইনস্টাইন’ উপাধি দেন।
সুবর্ণের পরিচিতি পর্বের মধ্যদিয়েই শুরু হয় এনবিসির সাক্ষাৎকার ( https://www.nbc.com/little-big-shots/video/icing-on-the-cake/4123747)
মেলিসা: পদার্থবিজ্ঞানী হওয়ার জন্য তোমার কি বো টাই দরকার?
সুবর্ণ: না, পদার্থবিজ্ঞানী হওয়ার জন্য কোন বো টাইয়ের দরকার নেই। আপনার কেবল দরকার অধ্যবসায় এবং পরবর্তী স্যার আইজ্যাক নিউটন এবং অ্যালবার্ট আইনস্টাইন হওয়ার স্বপ্ন। কিন্তু আপনি যদি আমার মতো কোনও ফেন্সি লুকিং ফিজিজিস্টর হতে চান, তবে বো টাই দরকার।
মেলিসা: ডার্ক চকলেটের সাথে কি ডার্ক ম্যাটারের কোন সম্পর্ক আছে?
সুবর্ণ: না, নিঃসন্দেহে কোনও সম্পর্ক নেই (হাস্যময়)।
মেলিসা: একেবারেই না?
সুবর্ণ: না
মেলিসা : ডার্ক ম্যাটার সমস্যা সমাধানের সময় তুমি কি ডার্ক চকলেট খাও?
সুবর্ণ: না, তবে চাইলে আমি দু’টি একই সাথে করতে পারি
মেলিসা: তুমি কি কখনও কিছু গুরুত্বপূর্ণ জিনিস ভুলে যাও, যেমন গত বছর যে তুমি সবুজ সোয়েটারটা পরেছিলে তা কি মনে আছে? তুমি কি প্রায়ই মনে মনে বল থাকো- কেন আমি সেই সবুজ সোয়েটারটা খুঁজে পাচ্ছি না?
সুবর্ণ: যতদুর মনে পড়ে আমি গত বছর সবুজ সোয়েটার পরিনি।
মেলিসা: তুমি কি নিশ্চিত?
সুবর্ণ: (কয়েক মুহূর্তের ভাবনার পরে) হয়তো পরেছি। আমার মনে নেই।
মেলিসা: দেখ আমি তোমাকে বলেছিলাম না যে তুমি সবকিছু মনে রাখতে পার না। আমি সঠিক ছিলাম।
সুবর্ণ: তুমি ঠিক মেলিসা! আসলে, এই জাতীয় প্রশ্ন আমাকে আইনস্টাইন সম্পর্কে মনে করিয়ে দেয়। তিনি নিজের গবেষণা কর্মে এতটাই নিবিষ্ট থাকতেন যে, একদিন আইনস্টাইন প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফেরার সময় তার বাড়ির ঠিকানাটি ভুলে গিয়েছিলেন।
মেলিসা: তুমি নিজেকে কিভাবে এত স্মার্ট ভাব?
সুবর্ণ: আমি স্মার্ট কারণ আমি এই অল্প বয়সেই পিএইচডি স্তরের গণিত সমস্যার সমাধান করতে পারি।
মেলিসা: বিষয় পরিবর্তন করা যাক! কি বল?
সুবর্ণ: ঠিক আছে
মেলিসা: প্রেসিডেন্ট ওবামা কেন তোমাকে স্বীকৃতি দিলেন?
সুবর্ণ: কারণ আমি পিএইচডি স্তরের গণিত, পদার্থবিজ্ঞান এবং রসায়ন সমস্যাগুলো সমাধান করতে পারি। ওবামার সেই চিঠি আমি পেয়েছি ২০১৬ সালের নভেম্বরে, যখন আমার বয়স মাত্র ৪ বছর। আমি বিস্ময়ে হতবাক যে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের মত গুরুত্বপূর্ণ এবং সদা ব্যস্ত একজন মানুষ আমাকে চিঠি লিখেছেন।
মেলিসা: এখন সিরিয়াস হয়ে যাই। কি বল?
সুবর্ণ: কোন সমস্যা নেই
মেলিসা: আমরা জন্য একটি বিশাল রোলার কোস্টার তৈরি করেছি। আমরা তোমাকে একটি বল এবং টেপ দেব। তুমি পদার্থবিজ্ঞান ব্যবহার করে বের করবে এক প্রান্তের সর্বনিম্ন কত উচ্চতা থেকে বলটি রিলিজ করতে হবে, যাতে এটি যথেষ্ট বেগ অর্জন করতে পারে এবং কোস্টারের অন্য প্রান্তে বেলুনটিকে বিস্ফোরণ করতে পারে।
সুবর্ণ প্রথমে টেপ দিয়ে রোলার কোস্টারের লুপের ব্যাসার্ধ পরিমাপ করলেন। তারপরে তিনি ফ্রি বডি ডায়াগ্রাম আঁকেন এবং সমীকরণগুলো পেতে নিউটোনিয় পদার্থবিজ্ঞান ব্যবহার করেন। তারপরে তিনি শক্তি সংরক্ষণ ব্যবহার করে বেলুনটি বিস্ফোরিত করতে পারে এমন ন্যূনতম বেগের জন্য প্রয়োজনীয় গতিবেগ শক্তিটি বের করতে। যা হল = h = 5r/2
একজন বাঙালি-আমেরিকান শিশু বিজ্ঞানীর টিভিতে এই উত্তেজনাপূর্ণ পরীক্ষাটি দেখে লক্ষ লক্ষ আমেরিকান শিশু পদার্থবিদ্যার প্রেমে পড়ে যায়!
কীভাবে একজন বাঙালি শিশু এই জনপ্রিয় টিভি রিয়েলিটি শো’র জন্য নির্বাচিত হন?
২০১৬ সালের কথা। সুবর্ণ আইজ্যাকের বাবা রাশিদুল বারী এনবিসির কাছে থেকে একটি ফোন কল পেলেন। তাকে জানানো হলো যে এনবিসির ‘লিটল বিগ শট’র জন্য বিশ্বের ২.২ বিলিয়ন শিশুর মধ্যে ৩০,০০০ শিশুকে প্রাথমিক তালিকায় রেখেছে যার একজন সুবর্ণ আইজ্যাক। তারা আরও জানাল যে, এনবিসি এই ৩০,০০০ শিশুর মধ্যে ২০ জনকে বেছে নেবে। গত চার বছর, এনবিসি সুবর্ণের কাছ থেকে ২৩টি সাক্ষাৎকার নিয়েছিল: তার মধ্যে কয়েকটি ছিল ফোন সাক্ষাৎকার, কয়েকটি ছিল লিখিত এবং কয়েকটি ছিল আইকিউ পরীক্ষা। সুবর্ণ প্রতিটি সাক্ষাৎকারে এবং পরীক্ষায় পাস করে ২০ জনের চূড়ান্ত তালিকায় নিজের নাম ঠাঁই করে নেয়।