পেঁয়াজের রাজধানীর খ্যাত পাবনার সুজানগর, সাঁথিয়া ও বেড়ায় এবার পেঁয়াজের (হালি) বাম্পার ফলন হয়েছে। জেলার বাজারগুলো এখন পেঁয়াজে সয়লাব। কিন্তু তাতে হাসি নেই পেঁয়াজচাষীদের মুখে। ফলনে সন্তুষ্ট হলেও দাম নিয়ে বিপাকে পড়েছেন কৃষকরা। লাভ তো দুরের কথা বীজ, জমির মূল্য, সার-কীটনাশক ও শ্রমিকের মজুরি মিলে উৎপাদন খরচই উঠছে না কৃষকের।
পাবনার হাজিরহাট, পুষ্পপাড়াহাট, বনগ্রাম হাট, আতাইকুলা বাজার, সুজানগরহাট, সাঁথিয়া বাজার, ধুলাউড়ি হাট, বেড়ার চতুরহাট, দুবলিয়ার হাটসহ বিভিন্ন হাট-বাজারঘুরে দেখা যায়, ভ্যান, করিমন, অটোরিকশা, ট্রলি, মিনি ট্রাকসহ বিভিন্ন পরিবহনের পেঁয়াজ নিয়ে বাজারে আসছেন চাষীরা। তেমন ক্রেতা না থাকায় হতাশ হয়ে বসে থাকতে দেখা যায়। দরদামে জোরাজুরি না করে পাইকারি ব্যাপারিরা দাম বলা মাত্রই পেঁয়াজ বিক্রি করে বাড়ি ফিরছেন তারা।
এবছর জেলায় হালি পেঁয়াজের আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪৪ হাজার ৪৫ হেক্টর জমিতে, কিন্তু লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে ৪৪ হাজার ৮১০ হেক্টর জমিতে তাহেরপুরী, ফরিদপুরী, বারি পেঁয়াজ-১, কলসনগর, লালতীর কিং, হাইঃ লালতীর, হাইঃ ইস্পাহানী ও হাই মেটাল জাতের পেঁয়াজ আবাদ হয়েছে, আর গত বছর আবাদ হয়েছিল ৪৪ হাজার ৩০ হেক্টর জমিতে। এবার উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৬ লাখ ৩৫ হাজার ৫১৩ মেট্রিক টন। এর মধ্যে সুজানগর উপজেলায় আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৬ হাজার ৫শ হেক্টর, আবাদ হয়েছে ১৭ হাজার ৩৫০ হেক্টর। এছাড়াও সাঁথিয়ায় ১৫ হাজার ৭শ এবং বেড়া উপজেলায় ৩ হাজার ৩৩০ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ আবাদ হয়েছে।
সুজানগরের খয়রান, দূর্গাপুর ও সাঁথিয়ার বনগ্রামের মাঠ ঘুরে দেখা যায়, কৃষকরা তীব্র গরম উপেক্ষা করেই পেঁয়াজ তুলছেন শ্রমিকরা। চাষীদের পরিবারের অন্য সদস্যরাও পেঁয়াজ মৌসুমে বসে নেই। নারী-শিশুরা ভোর রাত থেকেই ব্যস্ত হয়ে পড়েন শ্রমিকদের খাবার রান্নার কাজে ও পেঁয়াজের মাথা কাটার কাজে। পরিবারের ছোট সন্তানটিও যেন বসে নেই, বাবার কাজের সাথে সেও যেন একজন পেশাদার কৃষক। মহিলারা গভীর রাত পর্যন্ত পেঁয়াজের অগ্রভাগ কাটতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।
সুজানগরের দূর্গাপুরের চাঁদ আলী মণ্ডল বলেন, ‘এবার আমি ২৫ বিঘা জমিতে পেঁয়াজ আবাদ করেছিলাম। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ফলন বেশ ভালো হয়েছে। কিন্তু বাজারে যে দাম দেখছি তাতে উৎপাদন খরচই নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারবো না। এভাবে বাজার দর অব্যাহত থাকলে আগামীতে পেঁয়াজ চাষ করব কিনা ভাবছি।’
বনগ্রাম হাটে কথা হয় কৃষিতে জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সুজানগরের ভায়না গ্রামের মোহাম্মদ কামরুজ্জামান প্রামাণিকের সঙ্গে। এবার তিনি আবাদ করেছেন ২০ বিঘা। দামে আশাহত হয়ে তিনি বলেন, ‘এক বিঘা জমিতে কীটনাশক খরচ ৩ হাজার টাকা, সার ও চাষ বাবদ ৫ হাজার টাকা। লেবার খরচ ১৫ হাজার টাকা। আর জমি লীজ নিতে হয় ২০ হাজার টাকা দিয়ে। সব মিলিয়ে বিঘাপ্রতি ৪০ হাজার টাকার ওপরে খরচ হয়েছে। এবার বিঘা প্রতি উৎপাদন হচ্ছে ৫০ থেকে ৬০ মন, আর বাজারে ৬শ থেকে সাড়ে ৮শ করে বিক্রি হচ্ছে তাতে ৩০ হাজার থেকে ৪০ হাজার টাকার পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে প্রতি বিঘায়।’
বেড়ার চতুরহাটে পাইকারী ক্রেতা করিম উদ্দিন বলেন, ‘এখন বাজারে প্রচুর পেঁয়াজ, কিন্তু চাহিদা কম। চাহিদা কম থাকায় দাম কম থাকবে এটাই স্বাভাবিক। এতে কৃষকরা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তেমন আমরা পাইকারী ব্যবসায়ীরাও ক্ষতির মুখে আছি। যেহেতু এটাই আমাদের পেশা তাই লাভ হোক আর লোকসান হোক ব্যবসা তো করতেই হবে।’
পাবনার হাজিরহাটে কৃষক শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘যেভাবে সার কীটনাশক, সার, বীজের দাম হয়েছিল, এখন বাজারে পেঁয়াজের দাম ঠিক উল্টোটা, উৎপাদন খরচই উঠছে না। আমরা কৃষকরা একেবারে শেষ হয়ে গিয়েছি। সরকার বাজার দর নিয়্ন্ত্রণ করে দাম না বাড়ালে আগামীতে মানুষ পেঁয়াজ চাষে আগ্রহ হারাতে পারে। পেঁয়াজের সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় উৎপাদনের সঙ্গে সঙ্গে পেঁয়াজ বিক্রি করে দিতে হয়। কিন্তু পরে দেখা যায় দাম বৃদ্ধি পেঁয়েছে, তাতে কৃষকরা আরও হতাশ হচ্ছেন।’
কৃৃষকরা জানান, ভরা মৌসুমেও আমদানি করা পেঁয়াজে বাজার সয়লাব। কম দামের বিদেশি পেঁয়াজ বাজারে থাকায় আমাদের দেশি পেঁয়াজের চাহিদা কম। এবার আমদানি কিছুটা কমিয়ে কৃষকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে যদি হিমাগার বা সংরক্ষণাগারে রাখে তাহলে দেশের মানুষ ও কৃষকরাও ব্যাপক লাভমান হতো, কিন্তু আমরা বার বার এসব দাবি করেও কোনও লাভ হয়নি। পেঁয়াজের সংরক্ষণাগার তৈরি করতে কোনও উদ্যোগই নেয়নি কর্তৃপক্ষ।
পাবনা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. মিজানুর রহমান বলেন, ‘কৃষি অফিসের সহযোগিতায় এবার ফলন ভালো হয়েছে। আমাদের ৬ লাখ ৩৫ হাজার ৫১৩ হেক্টর জমিতে এবার চাষ হয়েছে। আর উৎপাদন হয়েছে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক বেশি। বাজারে চাহিদা কম থাকায় দাম একটু নিম্নমুখি। তবে পেঁয়াজগুলো যদি সংরক্ষণ করে কিছুদিন পড়ে বিক্রি করে তাহলে কৃষকরা আরও ভালো দাম পেত।’
তিনি বলেন, ‘কৃষকরা যাতে পেঁয়াজের সঠিক দাম পান এজন্য সরকারি পেঁয়াজ সংরক্ষণাগার তৈরির জন্য উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে প্রস্তাবনা দিয়েছি। আশা করছি- খুব শিগগিরই পাবনায় একটি বড় আকারের পেঁয়াজ সংরক্ষণাগার তৈরি করা সম্ভব হবে।’
………………………………>
আমাদের ইউটিউব চ্যানেলটি সাবস্ক্রাইব করুন এবং পাবনার খবরাখবর রাখুন