উত্তরাঞ্চলের ভাষা আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ

১২৩ বছর শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছে অবিভক্ত বাংলার ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ পাবনা সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ। এটি অবিভক্ত বাংলায় ব্রিটিশ শাসনামলে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের একটি ঐতিহাসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ১৮৯৮ সালে শ্রী গোপালচন্দ্র লাহিড়ী কলেজটি প্রতিষ্ঠা করেন। ছায়াঘেরা সুবিশাল ক্যাম্পাসের এডওয়ার্ড কলেজ লেখাপড়ার পাশাপাশি ছাত্র রাজনীতি, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডেও দেশজুড়ে আলোচিত ছিল।

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, ১৮২৮ সালে পাবনা জেলার ভৌগোলিক সীমানা নির্ধারিত হওয়ার পর এ অঞ্চলে শিক্ষা প্রসারের কথা চিন্তা করা হয়। ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দের জুলাইয়ে শ্রী গোপাল চন্দ্র লাহিড়ী পাবনায় প্রথমে ‘পাবনা ইনস্টিটিউশন’ (বর্তমান গোপাল চন্দ্র ইনস্টিটিউট) নামে একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে ১৮৯৮ সালে এ বিদ্যালয়ের একটি কক্ষেই গোপাল চন্দ্র লাহিড়ী এডওয়ার্ড কলেজের কার্যক্রম শুরু করেন।

পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ (১৮৯৮) ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে বহু আন্দোলন-সংগ্রামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। ১৮৯৪ সালে শিক্ষানুরাগী শ্রী গোপালচন্দ্র লাহিড়ী নিজ বাড়িতে পাবনা ইনস্টিটিউট নামে যে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ১৯১১ সালে তা কলেজে রূপান্তরিত হয় এবং সম্রাট সপ্তম এডওয়ার্ড’র স্মৃতি রক্ষার্থে তার নামকরণ করা হয় এডওয়ার্ড কলেজ।

উত্তরাঞ্চলের অন্যতম বৃহৎ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে এই কলেজ এ অঞ্চলের ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। বামধারার প্রগতিশীল রাজনীতি যেমন এখানে বিকশিত হয়, তেমনি প্রতিক্রিয়াশীলদেরও শক্ত অবস্থান ছিল এই কলেজে। স্বদেশি আন্দোলন, অসহযোগ আন্দোলন, সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন, পাকিস্তান আন্দোলন, ভাষা-আন্দোলন, স্বাধিকার সংগ্রাম এবং সর্বোপরি একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে এখানকার ছাত্ররা অংশগ্রহণ করেন এবং অনেকে দেশের জন্য জীবনোৎসর্গ করেন।

ভাষা-আন্দোলনের দুই পর্বেই এখানকার ছাত্র-শিক্ষকরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। ১৯৪৮ সালে ভাষা-আন্দোলন শুরু হলে এই কলেজের শিক্ষক মওলানা আবদুল হামিদসহ অনেকেই তার সঙ্গে যুক্ত হন। এ সময় গঠিত রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের যুগ্ম-আহ্বায়ক ছিলেন এডওয়ার্ড কলেজের ছাত্রনেতা এ এল এম মাহবুবুর রহমান খান। ১ মার্চ পুলিশ তাকে গ্রেফতার করলে এডওয়ার্ড কলেজের ছাত্ররা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। ২ মার্চ সন্ধ্যা ৭টায় এডওয়ার্ড কলেজের টাউন হোস্টেলে এক বৈঠক হয়।

বৈঠকে আমিনুল ইসলাম বাদশা, লুৎফর রহমান এবং অন্যরা উপস্থিত ছিলেন। পরে গোয়েন্দা পুলিশের উপস্থিতির ফলে সভা পণ্ড হয়ে যায়। ৩ মার্চ এডওয়ার্ড কলেজের হোস্টেলে আরও একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। এ পর্বে এডওয়ার্ড কলেজের ছাত্রদের সংগঠিত করে ভাষা-আন্দোলনে সম্পৃক্ত করতে পাবনায় এসেছিলেন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের তখনকার কেন্দ্রীয় নেতা আবদুল মতিন, পরবর্তীকালে যিনি ‘ভাষা মতিন’ নামে পরিচিত হন।

এ প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, ‘১১ মার্চ ১৯৪৮ সংগ্রাম পরিষদ সারা পূর্ববঙ্গে ধর্মঘট আহ্বান করে। ছাত্রলীগের নেতারা হরতালে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য আমাকে পাবনা যাওয়ার নির্দেশ দেন। আমি পাবনা যাই। ১১ মার্চ ১৯৪৮ পাবনায় সফল হরতাল পালিত হয় এডওয়ার্ড কলেজে এক বিরাট ছাত্রসভায় বক্তৃতা দিই। (একুশের পটভূমি একুশের স্মৃতি, পৃ. ৬৮)

আবদুল মতিন ছাড়াও এ সময় এডওয়ার্ড কলেজের ছাত্রদের সংগঠিত করতে এসেছিলেন ছাত্রনেতা মোহাম্মদ সুলতান। পাবনায় বায়ান্নর ভাষা-আন্দোলনেরও কেন্দ্রবিন্দু ছিল এই কলেজ। ১৯৫১-৫২ সালে এখানকার ছাত্র-সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের নেতা আবদুল মমিন তালুকদার। ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি ঢাকার পল্টন ময়দানে এক জনসভায় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দিলে সারা দেশের মতো পাবনা তথা এডওয়ার্ড কলেজেও আন্দোলনের ঢেউ লাগে। ছাত্রনেতা আবদুল মোমিন তালুকদারকে আহ্বায়ক করে গঠিত হয় ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’।

এডওয়ার্ড কলেজের ভাষা-অন্দোলনের ইতিহাসে জড়িত আছে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ও মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নাম। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ভাষা-আন্দোলন সমসাময়িককালে অর্থাৎ ১৯৫১ সালের শেষের দিকে এডওয়ার্ড কলেজের বার্ষিক মিলাদ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে এসেছিলেন বলে উল্লেখ রয়েছে গোলাম সাকলায়েনের ‘অন্তরঙ্গ আলোকে ডক্টর শহীদুল্লাহ্’ নামক বইতে।

ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ওই অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের সামনে রাষ্ট্রভাষা বাংলা প্রসঙ্গে কথা বলেন। উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার বিষয়টিকে অযৌক্তিক বলে অভিহিত করেন এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন।

ভাষা-আন্দোলনের সময় মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী একাধিকবার এডওয়ার্ড কলেজের ছাত্রসমাবেশে বক্তৃতা করেন। ১৯৫২ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি এডওয়ার্ড কলেজ প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত ছাত্রসভায় তিনি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলনে যুক্ত হওয়ার জন্য ছাত্রসমাজকে আহ্বান জানান।

আবদুল মমিন তালুকদার লিখেছেন, ‘মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী তার জামাতা পাবনার বিশিষ্ট এডভোকেট আব্দুস সবুর খান সাহেবের বাড়িতে যান এবং আমাকে তার সঙ্গে দেখা করার জন্য লোক দিয়ে ডেকে পাঠান। আমি দেখা করতে গেলে আমরা বাংলা ভাষা রাষ্ট্রভাষা করার ব্যাপারে কী করছি জিজ্ঞাসা করেন। আমরা তার সঙ্গে আলোচনা করে ১৭ ফেব্রুয়ারি এডওয়ার্ড কলেজ মাঠে একটি ছাত্র-জনসভা করার সিদ্ধান্ত নিই এবং ওই সভায় বক্তব্য রাখার জন্য অনুরোধ করি। তিনি রাজি হন। আমরা কলেজ-স্কুলসমূহ সম্মিলিত সিদ্ধান্ত নিই এবং প্রচার শুরু করি।

১৭ ফেব্রুয়ারি সমগ্র পাবনা শহরে উত্তেজনা। বিকেল ৩টায় কলেজ মাঠে বিশাল ছাত্র-জনতার সমাগম ঘটে। অবশেষে মওলানা সাহেব এলেন কিন্তু সামান্য বক্তব্য রাখলেন ২১শে ফেব্রুয়ারির আন্দোলনের ডাক সম্পর্কে।’ (ভালবাসি মাতৃভাষা, পৃ. ৫৩)

২১শে ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রঘোষিত কর্মসূচি পালনে আগের দিন থেকেই এডওয়ার্ড কলেজের ছাত্ররা তৎপর হয়ে ওঠেন।

‘পাবনায় ভাষা-আন্দোলন’ গ্রন্থে বলা হয়েছে, ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে এডওয়ার্ড কলেজের টাউন হোস্টেলে ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি’র এক জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওইদিন জেলা প্রশাসন পাবনা শহরে ১৪৪ ধারা জারি করে। ছাত্ররা টাউন হোস্টেলের বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেয়, চারজনের ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে তারা এডওয়ার্ড কলেজের আমতলা থেকে মিছিল নিয়ে শহর প্রদক্ষিণ করবে। একইসঙ্গে বিকেলে এডওয়ার্ড কলেজ প্রাঙ্গণে সমাবেশ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। (পাবনায় ভাষা আন্দোলন, পৃ. ১০৮)

২০শে ফেব্রুয়ারির সিদ্ধান্ত মোতাবেক ২১শে ফেব্রুয়ারি সকাল থেকেই এডওয়ার্ড কলেজের আমতলায় শত শত শিক্ষার্থী জমায়েত হওয়া শুরু করেন। এরপর আবদুল মমিন তালুকদারের নির্দেশনা ও নেতৃত্বে সুশৃঙ্খলভাবে ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল বের করেন। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগান দিতে দিতে তারা পাবনা শহরের মূল সড়ক প্রদক্ষিণ করেন। বিকেলে এডওয়ার্ড কলেজ প্রাঙ্গণে বিরাট ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সময়কার ‘দৈনিক আজাদ’ ও ‘সাপ্তাহিক সৈনিক’ পত্রিকায় এ সংবাদ লিপিবদ্ধ আছে।

২১শে ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ছাত্র-জনতার ওপর গুলিবর্ষণের সংবাদ পাবনায় পৌঁছালে ছাত্ররা ক্ষোভে ফেটে পড়েন। রাতেই এডওয়ার্ড কলেজের টাউন হোস্টেলে আবদুল মমিন তালুকদারের সভাপতিত্বে ছাত্রদের জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ২২শে ফেব্রুয়ারি এডওয়ার্ড কলেজের ছাত্ররা পাবনা শহরে সর্বাত্মক ধর্মঘট পালন করেন এবং মিছিল-সমাবেশে অংশ নেন। প্রায় তিন হাজার ছাত্র শোভাযাত্রা বের করে পাবনা শহরের প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করেন।

সবকিছু বিচার-বিশ্লেষণ করে বলা যায়, ভাষা আন্দোলনে পাবনা জেলার সংগ্রামী ছাত্র-জনতার অবদান বিশেষভাবে স্মরণীয়। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাজপথে নেমেছেন, জেল-জুলুম-অত্যাচার সহ্য করেছেন। মুসলিম লীগের প্রতাপের যুগে পাবনার সংগ্রামী জনতা যেভাবে ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন তা সত্যিই প্রশংসার দাবিদার। কোনো বাধাই তাদের আন্দোলনের গতি থামাতে পারেনি। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে এখানকার সংগ্রামী মানুষের অবদান স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

৫২ পরবর্তী সময়েও এডওয়ার্ড কলেজের ছাত্ররা একুশের চেতনা সমুন্নত রাখতে এবং বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে সোচ্চার থাকে। ১৯৫৩ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি পাবনার জিন্নাহ পার্কে প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সম্মেলন আহ্বান করা হয়। এ উপলক্ষে ভাষা-আন্দোলনের দুশমন তৎকালীন পূর্ববাংলার মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমীন, আবদুল কাইয়ুম এবং সরদার আবদুর রব নিস্তার পাবনায় আসেন। নুরুল আমীনের পাবনায় আগমনের প্রতিবাদে এডওয়ার্ড কলেজের ছাত্ররা সংগঠিত হন এবং ‘ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করেন। পরে এডওয়ার্ড কলেজসহ পাবনার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রী ও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের প্রতিবাদ-প্রতিরোধের মুখে নুরুল আমীন ও তার সফরসঙ্গীরা পাবনা ছাড়তে বাধ্য হন।

ভাষা-আন্দোলনের শহীদদের স্মৃতি স্মরণীয় করে রাখতে এডওয়ার্ড কলেজের ছাত্ররা তাৎক্ষণিকভাবে কালো কাপড় দিয়ে শহীদ মিনার নির্মাণ করেন। পরে ১৯৫৪ সালে এডওয়ার্ড কলেজ ছাত্র-সংসদ নেতৃবৃন্দ কলেজের পুরনো ভবনের সামনে শহিদ মিনার নির্মাণ করেন। (ভাষা আন্দোলনের আঞ্চলিক ইতিহাস, পৃ. ১৯৭)

ভাষা-আন্দোলনে এডওয়ার্ড কলেজের ছাত্রদের অবদান ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। ভাষা-আন্দোলন তাদের চেতনায় যে উদ্দীপনা সৃষ্টি করেছিল তার সূত্র ধরেই তারা ৫৪-র নির্বাচন, ৬২-র ছাত্র আন্দোলন, ৬৬-র ৬-দফা আন্দোলন, ৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, ৭০-এর নির্বাচন এবং ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে ব্যাপক অবদান রেখেছেন।

এক কথায় বলা যায়, ভাষা-আন্দোলন তথা পূর্ব বাংলার আন্দালন-সংগ্রামের ইতিহাসে এডওয়ার্ড কলেজ গৌরবময় স্থান দখল করে আছে।

error: কাজ হবি নানে ভাই। কপি-টপি বন্ধ