পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার চরভদ্রকোলা গ্রামের মোক্তার আলী গত শনিবার (১৮ জুলাই) দুটি গরু নিয়ে জেলার অন্যতম বড় পশু হাট বনগ্রাম হাটে যান। গরু দুটি ৬ মাস আগে তিনি এক লাখ ৪০ হাজার টাকায় কিনেছিলেন। অনেক যত্ন ও খরচ করে গরু দুটি ৬ মাস ধরে তিনি লালন পালন করেন ঈদের হাটে লাভে বেঁচবেন বলেন।
তিনি বলেন, হাটে কেনা দামও বলছে না গরু দুটির। অথচ প্রতিটি গরুর পেছনে প্রতিদিন খাবার বাবদ খরচ হয়েছে প্রায় ৪০০ টাকা। এখন হাটে এসে দেখছি গরু কেনার লোকই কম। কেনার লোকই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
মোক্তার আলীর মতো পাবনা জেলায় বাণিজ্যিক ভিত্তিতে গরু মোটাতাজাকরণ কাজে নিয়োজিত প্রায় ২১ হাজার খামারি এবার হতাশ। গবাদি পশু ব্যবসার ব্যাপারী ও হাট ইজারাদারদেরও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। কারণ এবার কুরবানির হাটে গরু-ছাগল ও মহিষের দাম গত বছরের তুলনায় ২০-২৫ শতাংশ কম।
জেলায় এ বছর কুরবানির হাটে প্রায় দুইশ কোটি টাকার গরু-ছাগল কেনা-বেচার সম্ভাবনা ছিল। তবে প্রাণিসম্পদ বিভাগের আশঙ্কা ছিল করোনা সংকটের কারণে তা বেশ কম হতে পারে।
পাবনা জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্ত আল-মামুন হোসেন জানান, গত এক দশক ধরে পাবনায় বাণিজ্যিক ভিত্তিতে গরু মোটাতাজাকরণ বেড়েছে।
তিনি জানান, মধ্যবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির লোকজন ষাঁড় পালন করে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন। কেউ পেশায়, কেউ বেকারত্বের অভিশাপ ঘোচাতে, কেউ সংসারে স্বচ্ছলতা আনতে এসব খামার গড়ে তুলেছেন বলে তিনি জানান। এরা সাধারণত এক বছর পর পোষা গরু বিক্রি করে দেন। অনেকে দু’বছর পর্যন্ত লালন-পালন করে থাকেন। ষাঁড়গুলো পবিত্র ঈদুল আজহার সময়েই সাধারণত বিক্রি হয়।
প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আরও জানান, বাণিজ্যিক ভিত্তিতে জেলায় প্রায় ২১ হাজার খামারি রয়েছেন, যারা গাভি ও ষাঁড় পালন করেন। আরও অন্তত ২০-২৫ হাজার ক্ষুদ্র কৃষক নিজ উদ্যোগে গরু মোটাতাজাকরণ করছেন। এছাড়া জেলায় প্রতি বছর প্রায় ১০ হাজার হতদরিদ্র মহিলা এনজিও’র টাকায় গরু পালন করে থাকেন। খামারি, ক্ষুদ্র কৃষক ও হতদরিদ্র গৃহিণীর পালন করা গরু মিলিয়ে প্রায় এক লাখ ২৫ হাজার গরু কুরবানির হাটে উঠবে।
এদিকে প্রায় ৪০ হাজার ক্ষুদ্রচাষির এক লাখ ১৫ হাজার হাজার ছাগল- ভেড়াও বাজারে উঠবে। সব মিলিয়ে দুই লাখ ৩৫ হাজার থেকে দুই লাখ ৪০ হাজার গরু-ছাগল- ভেড়া বিক্রি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। গড় দাম হিসেব করে পাবনা থেকে প্রায় দু’শ থেকে দু’ বিশ কোটি টাকার গরু- ছাগল বিক্রির টার্গেট ছিল। তবে করোনা সংকটে কারণে দাম ২০-২৫ শতাংশ কমে যাওয়ায় এ লক্ষ্যমাত্রা ব্যাহত হতে পারে বলে প্রাণিসম্পদ বিভাগ জানিয়েছে।
উত্তরাঞ্চলের অন্যতম বৃহত্তম গরু হাট সাঁথিয়ার বনগ্রাম হাটে শনিবার (১৮ জুলাই) সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা যায়, গরু, ছাগল, মহিষ হাটে উঠলেও কেনার লোক খুব কম। ঢাকায় গরু সরবরাহকারী ব্যাপারীদের দেখা নেই। সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, স্থানীয় যেসব ব্যাপারী কয়েক মাস আগে গরু কিনে রেখেছিলেন তারাও ক্ষতির মুখে পড়েছেন।
মাহমুদপুর গ্রামের মোন্তাজ আলী মোল্লা জানান, তিনি দুটি ষাঁড় নিয়ে হাটে এসেছেন। কিন্তু খুবই কম দাম হচ্ছে।তিনি জানান, গত বছর লাখ টাকায় যে গরু বিক্রি হয়েছে এবার তার দাম ৭০- ৭৫ হাজার টাকা। এতে খামারি , ক্ষুদ্র কৃষক সবাই ক্ষতিগ্রস্ত। কারণ হিসেবে জানান, গোখাদ্যের দাম প্রতি বছর বেড়েই চলেছে।
বনগ্রাম এলাকার কানু বিশ্বাস নামের এক ছাগল (খাসি) বিক্রেতা জানান, তিনি হাটে এসে ক্রেতা খুঁজে পাচ্ছেন না। দাম খুবই কম। জানালেন, গত বছরের চেয়ে অন্তত ২০ শতাংশ দাম কম। অথচ দাম আরও ২০ শতাংশ বৃদ্ধি পাওয়া উচিত ছিল। গাঙ্গহাটি গ্রামের শাহীন নামের এক তরুণ ছাগল (খাসি) ব্যবসায়ী বলছিলেন, তিনি দুটি খাসি নিয়ে এসেছেন ৪ ঘণ্টা আগে। এ সময়ের মধ্যে কেউ দামই বলেনি। তিনি জানান, গত বছর যে খাসির দাম ছিল ১৩- ১৪ হাজার টাকা এবার সে খাসির দাম ৮-৯ হাজার টাকা। হাটখোলার বেলাল হোসেন জানান, তিনি খাসি নিয়ে এসেছেন। দাম হচ্ছে মাত্র ৮ হাজার টাকা। তার আশা ছিল খাসিটির দাম হবে ১১ হাজার টাকা।
বেচা-কেনা কম ও দাম কম হওয়াতে হাট ইজারাদারগণও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বলে জানান। আবুল কাশেম নামের এহজন হাটইজারাদার প্রতিনিধি জানান, দাম কম হওয়ায় তারাও ক্ষতিগ্রস্থ। কারণ হিসেবে জানান, প্রতিযোগিতা করে তারা হাট ডাকে অংশ নেন। কুরবানির মৌসুমে হাটের খাজনা আদায়ে তাদের বিনিয়োগ করা বিরাট অংশের টাকা উঠে আসে। এবার দাম যত কম হবে কিম্বা বিক্রি যত কম হবে তাদের খাজনা আদায় তত কমে যাবে।
এদিকে ঢাকায় যারা প্রতি বছর গরু নিয়ে যেতেন তারাও এ পর্যন্ত চুপচাপ। জেলার বেশ কয়েকজন প্রতিষ্ঠিত গরু ব্যবসায়ীর সাথে কথা বলে জানা গেছে, গত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতায় তারা এবার ভেবে-চিন্তে গরু কিনবেন।
এদের একজন আতাইকুলা থানার আজগার আলী জানান, ঢাকায় গরু নিলেই ‘তিনদিনে লাখপতি’ হওয়া যায় এমন রঙিন স্বপ্নে অনেক আনাড়ি লোকজন এলাকা থেকে বেশি দামে গরু কিনে ঢাকায় নেয়। এতে অন্যসব ব্যাপারিও বেশি দামে এলাকা থেকে গরু কিনতে বাধ্য হন। শেষ পর্যন্ত ঢাকার চাহিদার তুলনায় বেশি সংখ্যক গরু সেখানে আমদানি হওয়ায় দাম পড়ে যায়। অনেক লোভি ফড়িয়া স্বর্বস্বান্ত হওয়ায় এবার তারা অনেকেই হাটে নেই বলে প্রতিষ্ঠিত গরু ব্যবসায়ীরা জানান।
তিনি আরও জানান, এবারের প্রেক্ষাপট আরও অন্যরকম। করোনা সংকটের জন্য গরু নিয়ে কোন হাটে যাবেন কিভাবে যাবেন এ নিয়েই তারা চিন্তাগ্রস্ত।
গরু ব্যবসায়ী জসীম উদ্দিন জানান, ঢাকায় গরু সরবরাহ করা ছিল লাভজনক।প্রতি বছর এতদিনে তারা খামারিদের বা চাষিদের বাড়ি বাড়ি থেকে গরু কিনে অস্থায়ী গোয়ালে রাখা শুরু করতেন। কিন্তু এবার তারা গরু নিয়ে ঢাকা যাবেন কিনা তা এখনও ঠিক করেননি।
এদিকে জেলার বিভিন্ন উপজেলায় খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, পাবনা জেলার বিভিন্ন এলাকায় শ’ শ’ গো-খামার গড়ে উঠেছে। এমন কোনো বাড়ি নেই যেখানে ২-৪টি গরু পালন হচ্ছে না। গরু পালন করে ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়েছেন অনেকেই। শুধু কুরবানি ঈদকে কেন্দ্র করেই বিগত এক দশকে গরু লালন পালন এবং কেনা বেচা করে বহু লোকজন নিজেদের ভাগ্য বদলে ফেলেছেন। কুরবানি ঈদ এলেই বা বছর ঘুরলেই লাখপতি এমন অনেক উদাহরণ রয়েছে। বেকার যুবক ও দরিদ্ররা খামার করে একদিকে যেমন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে অন্যদিকে সচ্ছলতা এনেছে সংসারে।
সংসারের অভাব ঘুঁচাতে অনেকেই ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে, অনেকেই বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণ সংগ্রহ করে গো-খামার গড়ে তুলেছেন। গো-খামার করে অনেক মহিলা-পুরুষ প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। বে-সরকারি সংস্থা ওসাকা, নিউএরা ফাউন্ডেশন, পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) থেকে তারা স্বল্প সুদে ঋণ নিয়ে গরু পালন করেন। আরও কয়েকটি বে-সরকারি সংস্থাও পাবনার দরিদ্র মহিলাদের মধ্যে গরু পালনের জন্য ঋণ বিতরণ করে থাকে।
সুবিধাভোগী কৃষক বামনডাঙ্গা গ্রামের বাবু মিয়া জানান, তারা গরু বিক্রি করে ঋণ শোধ করেন। এ বছর ভালো দাম না পেলে তাদের লাভ থাকবে না।
সাঁথিয়ার বহলবাড়িয়া গ্রামের স্কুলশিক্ষক আফসার আলী ও বিষ্ণুপুর গ্রামের জালাল উদ্দিন জানান, ভালো জীবনযাপন করতে গেলে শুধু বেতনের উপর নির্ভর করলে চলে না। তাই প্রতি বছর একটি করে গরু পালন করি। কুরবানির ঈদে প্রায় লাখ টাকায় বিক্রি করি।কিন্তু এবার গবাদিপশুর দাম পড়ে যাওয়ায় তারা হতাশ বলে জানান। জেলায় তাদের মতো এরকম হাজার-হাজার পার্টটাইম ষাঁড় চাষি রয়েছে বলে তারা জানান।
এদিকে দাম কমে যাওয়ায় ক্রেতারা কিন্তু খুশি।পাবনা সদর উপজেলার অবসরপ্রাপ্ত কৃষি কর্মকর্তা আব্দুল খালেক বলেন, এবার কুরবানির জন্য যে গরু ৬০ হাজার টাকা দিয়ে কিনেছি সেই গরু গত বছর বিক্রি হয়েছে ৮০ হাজার টাকায়।
কয়েকজন গরুচাষি জানান, খামার গড়তে যে পরিমাণ টাকার প্রয়োজন সেই পরিমাণ টাকা নেই অনেকেরই। বিভিন্ন এনজিও এবং ব্যাংক থেকে অর্থনৈতিক সহযোগিতা নিয়ে খামার গড়েছেন অনেকে। কিন্তু তাতে সুদের হার অত্যন্ত বেশি।
তারা জানান, এখন গোখাদ্যের দাম আকাশ ছোঁয়া। এতে সারা বছরের খরচ আর পরিশ্রমের টাকা বাদ দিলে খুব লাভবান হওয়া যায় না। এবার করোনা সংকট গো-খামারিদের ক্ষতিগ্রস্ত করেছে বলে তারা জানান।
এদিকে সুজানগর উপজেলার মাঠ পর্যায়ের একজন পশু চিকিৎসক আব্দুর রশিদ জানান, তার জানামতে খামারি বা ক্ষুদ্র চাষিরা আর ক্ষতিকর ওষুধ খাইয়ে গরু মোটাতাজা করেন না। গরু চাষিরা এখন স্বাস্থ্যসম্মত খাবার ও ওষুধ খাইয়ে গরু পালন করেন।
তবে এক শ্রেণির ব্যাপারি ও ফড়িয়া এ কাজের সাথে জড়িত থাকেন। তারা সাধারণত কুরবানির ১৫ দিন বা এক মাস আগে গরু কিনে নিষিদ্ধ ওষুধ খাইয়ে গরুকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তোলেন। ওষুধের দোকানগুলোতে এ নিয়ে নজরদারি বাড়ানোর কথা বলেছেন অনেকেই।
এ ব্যাপারে জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আল-মামুন হোসেন জানান, পাবনা এলাকায় গরুচাষিদের মধ্যে স্টেরয়েড জাতীয় ক্ষতিকর ওষুধ খাওয়ানোর প্রবণতা নেই। মোলাসেস, দানাদার খাবার, কাঁচা ঘাস, খড় খাওয়ানের কারণে কয়েক মাসের মধ্যে গরু এমনিতেই মোটাতাজা হয়ে যায়। আর পাবনা এলাকায় যে পরিমাণ গো-খাদ্য উৎপাদিত হয় তাতে গো- খাদ্যের জন্য তাদের কোনো বাড়তি চিন্তা করারই প্রয়োজন নেই।
জেলা ওষুধ তত্ত্বাবধায়ক কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক (এডি) কে, এম, মুহসীনিন মাহবুব জানান, পাবনায় গবাদি পশুর কোনো ক্ষতিকর ওষুধ বেচা কেনা হয় না। তাই ক্ষতিকর ওষুধ খাওয়ানোর সুযোগই নেই।