ভাষা সৈনিক, বীর মুক্তিযোদ্ধা, একুশে পদকপ্রাপ্ত দেশের বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলামিষ্ট এবং পাবনা প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক রণেশ মৈত্রের (৯০) শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়েছে। শুক্রবার (৩০ সেপ্টেম্বর) বিকেলে পাবনা মহাশ্মশানে তাকে দাহ করা হয়।
এর আগে দুপুর থেকে বিকাল পর্যন্ত পাবনার বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম বকুল স্বাধীনতা চত্বরে ও পাবনা প্রেসক্লাব চত্বরে তার মরদেহে শেষ শ্রদ্ধা জানান বিভিন্ন দল ও সংগঠনের নেতারা। দুপুর ২টা থেকে ৩টা পর্যন্ত স্বাধীনতা চত্বরে রাখা হয়। এসময় তাকে সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) রেইনা ইসলাম ও পাবনা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আমিনুল ইসলামের নেতৃত্বে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় গার্ড অফ অনার প্রদান করা হয়।
পরে বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানানো হন। এসময় শ্রদ্ধা জানান জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার অ্যাডভোকেট শামসুল হক টুকু, পাবনা সদর আসনের সংসদ সদস্য গোলাম ফারুক প্রিন্স, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান রেজাউল রহিম লাল, জেলা পরিষদের নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান আব্দুর রহিম পাকন, জেলা প্রশাসক বিশ্বাস রাসেল হোসেন ও পুলিশ সুপার আকবর আলী মুন্সী প্রমুখ।
পরে বিকেল তিনটার দিকে তাকে নেয়া হয় তার প্রিয় কর্মস্থল পাবনা প্রেসক্লাব চত্বরে। এ সময় পাবনা প্রেসক্লাবের সভাপতি এটিএম ফজলুর রহমান ও সম্পাদক সৈকত আফরোজ আসাদের নেতৃত্বে পাবনা প্রেসক্লাব ও পাবনায় কর্মরত সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানানো হয়। সেখানে প্রায় আধাঘন্টা অবস্থানের পর আমরা দেহ সকল ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতার শেষে পাবনা মহাশ্মশানে নেয়া হয় এবং সেখানে সনাতন ধর্মীয় নিয়ম অনুযায়ী দাহ করা হয়।
উল্লেখ্য গত সোমবার (২৬ সেপ্টেম্বর) ভোর ৩টা ৪৭ মিনিটে ঢাকা পপুলার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন। সন্তানরা বিদেশে অবস্থান করায় ঢাকায় মরদেহ সংরক্ষণ করে আজ পাবনায় নিয়ে এসে শেষকৃত্য সম্পন্ন করা হলো।
পাবনা প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক রণেশ মৈত্র সম্প্রতি মফস্বল সাংবাদিকতায় বিশেষ অবদান রাখায় বসুন্ধরা মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেন। দেশবরেণ্য এই গুণীজনের পরলোকগমনের খবর পাবনায় ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে বিভিন্ন স্তরের মানুষের মধ্যে নেমে আসে শোকের ছায়া।
জানা গেছে, ১৯৩৩ সালের ৪ অক্টোবর রাজশাহী জেলার ন’হাটা গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। পৈত্রিক বাসস্থান পাবনা জেলার সাঁথিয়া উপজেলার ভুলবাড়িয়া গ্রামে। বাবা রমেশ চন্দ্র ছিলেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক। সপ্তম শ্রেণিতে ওঠার পর থেকেই রণেশ মৈত্র টিউশনি করে নিজের লেখাপড়ার খরচ চালাতেন। নিজ জীবন সংগ্রাম থেকে শিক্ষা নিয়েই রণেশ মৈত্র দেশের অসহায়, শোষিত ও বঞ্চিত মানুষের জন্য আন্দোলন ও সংগ্রাম করেন। ১৯৫০ সালে পাবনা জিসিআই স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। ১৯৫৫ সালে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ থেকে আইএ এবং ১৯৫৯ সালে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন।
সাংবাদিকতা শুরু করেন ১৯৫১ সালে। সিলেট থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক নওবেলাল পত্রিকায় সাংবাদিকতার মাধ্যমেই তার সাংবাদিকতা জীবন শুরু। এরপর কলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক সত্যযুগে তিন বছর সাংবাদিকতার পর ১৯৫৫ সালে তিনি যোগ দেন দৈনিক সংবাদে। ১৯৬১ সালে ডেইলি মর্নিং নিউজ এবং ১৯৬৭ সাল থেকে ১৯৯২ পর্যন্ত দৈনিক অবজারভারে পাবনা প্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯২ সালে দি নিউ নেশনের মফস্বল সম্পাদক হিসেবে যোগ দেওয়ার পর ১৯৯৩ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত দি ডেইলি স্টারের পাবনা প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেন। পরে স্বেচ্ছায় অব্যাহতি নিয়ে একজন ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক হিসেবে দেশের শীর্ষ পত্রপত্রিকায় কলাম লিখে সারাদেশে ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেছেন।
এছাড়া ১৯৬১ সালে পাবনায় পূর্ব পাকিস্থান মফস্বল সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে গঠিত পূর্ব-পাকিস্থান সাংবাদিক সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এই সম্মেলনের মাধ্যমে মফস্বল সাংবাদিকরা তাদের পেশার স্বীকৃতি পায়। সেই বছরেই প্রতিষ্ঠিত পাবনা প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
এছাড়া তিনি দীর্ঘদিন প্রেসক্লাবের সভাপতি ও সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করে জেলার সাংবাদিকদের নেতৃত্ব দিয়েছেন। সাংবাদিকতায় অবদানের জন্য তিনি ২০১৮ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার প্রদত্ত দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদকে ভূষিত হন ।
১৯৪৮ সালে ছাত্র ইউনিয়ন থেকে ভাষা আন্দোলনের মিছিলে যোগ দেওয়ার মধ্য দিয়ে শুরু হয় রণেশ মৈত্রের রাজনৈতিক জীবন। একই সময়ে সাংবাদিকতা পেশায় জড়িয়ে পড়েন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে জেল খেটেছেন। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে তিনি পাবনা জেলার অন্যতম সংগঠক ছিলেন। সেই বছরেই তিনি ছাত্রইউনিয়নের জেলা সাংগঠনিক কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৫৩ সালে এডওয়ার্ড কলেজের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে সাংস্কৃতিক সম্পাদক নির্বাচিত হন।
রাজনৈতিক আন্দোলনের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক আন্দোলন জোরদার করার লক্ষ্যে তিনি বাংলাদেশ অবজারভারের আব্দুল মতিন, কামাল লোহানীসহ প্রগতিশীল বন্ধুদের সঙ্গে গঠন করেন শিখা সংঘ নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন। সেখানে একটি সমৃদ্ধ পাঠাগার ছিল, যেখান থেকে শিখা নামে একটি হাতে লেখা পত্রিকাও প্রকাশিত হতো।
তার স্ত্রী পূরবী মৈত্র বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের পাবনা জেলা শাখার সভাপতি। ৪ ছেলেমেয়ে সবাই নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। গুণি এই ব্যক্তির পরলোকগমনে তাৎক্ষণিক ভাবে পাবনার সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিকসহ নানা পেশাজীবি সংগঠন ও নানা শ্রেণিপেশার মানুষ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে শোক ও শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা এবং তাঁ বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করেছেন।