শামসুল আলম
বর্ষাকালে মুগ্ধকর অপরূপ জলরাশি, কখনও উত্তাল আবার কখনও নিঃশব্দ-শান্ত। চোখধাঁধানো জলরাশির মাঝে পাল উড়িয়ে ঘুরছে ডিঙি নৌকা। আর হেমন্ত, শীত ও বসন্তে জেগে উঠে ধুধু বালুর চর। দেশের অন্যতম যুগল খ্যাত দুই সেতুর তলদেশে বয়ে চলা নদীর বুকে জেগে উঠা চরই যেনে মনে করিয়ে দেয় কোনও সমুদ্রসৈকতের আবেগ। কূল থেকে অপূর্ব সূর্যাস্ত! চারিদিকে কোলাহল মুক্ত সবুজের বেস্টনি। কি অপরুপ দৃশ্য!
বলছিলাম প্রমত্তা কীর্তিনাশা তথা দেশের অন্যতম প্রধান নদী পদ্মার বুখে দাঁড়িয়ে থাকা শতবর্ষী ঐতিহাসিক পাকশী হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ও লালন শাহ সেতুর কথা। যার পাদদেশে প্রতিদিন হাজারো ভ্রমণ পিপাসুদের ঢল নামে। পদ্মার বুকে জায়গা করে নেয়া এই বিনোদন স্পটটি পাবনা ও আশপাশের জেলার মানুষদের সময় কাটানোর জায়গা হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
সম্প্রতি এটি আরও জনপ্রিয় ও ভ্রমণ পিপাসুদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে কেননা, পদ্মার পাড়েই তৈরি হচ্ছে দেশের সবচেয়ে বড় প্রকল্প রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। যাকে ঘিরে চলছে মহাকর্মযজ্ঞ। এছাড়াও পাকশীকে মানুষের চাহিদার অন্যতম কারণ- এতিহ্যবাহী পাকশী পেপার মিল, ফুরফুরা শরীফ, ঈশ্বরদী বিমানবন্দর, বিশাল অঞ্চল নিয়ে পশ্চিম রেলওয়ের পাকশী বিভাগীয় কার্যালয়, বিবিসি বাজার ও রিসোর্টসহ ঐতিহাসিক কিছু স্থাপনা।
রূপ মাধুর্যে ভরা পাকশীর জোড়া সেতু এলাকায় মুক্ত বাতাসে সময় কাটাতে প্রতিদিন হাজারো মানুষের ভিড় থাকলেও শুক্রবার ও ছুটির দিনগুলোতে এখানে পা রাখার জায়গা থাকে না। দৃষ্টিনন্দন জোড়া ব্রিজের পাদদেশে এমন প্রকৃতির মনোরম দৃশ্য ও শান্ত-প্রশান্তের পরিবেশে পাবনা ও আশপাশের জেলাগুলো থেকে মানুষ পরিবার ও বন্ধু-বান্ধব নিয়ে ছুটে আসেন।
পাকশীর এই স্থান ও ব্রিজটি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন বহন করছে। হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী যখন পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে তখন দেশের সূর্যসন্তানের যেমন নিশ্চিহ্ন করে দিতে চেয়েছিল, তেমনি ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলোও ধ্বংস করে দিতে চেয়েছিল। সেই প্রয়াসে একাত্তরের ১১ ডিসেম্বর পাকবাহিনী দুটি জেট বিমান দিয়ে বোমা মেরে উড়িয়ে দেয়া হয় ব্রিজটির ১২ নম্বর স্প্যানটি। মহানযুদ্ধে বাঙালি তাদের বিজয় ছিনিয়ে নিলে ব্রিটিশ সরকারের সহযোগিতায় আবারও পদ্মার বুকে বীরদর্পে দাঁড়িয়ে ওঠে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ। এমন ইতিহাস ও প্রাচীন ঐতিহ্যে ঘিরে পাকশীকে বিশ্বমানের পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার দাবি এখানে ঘুরতে আছে ভ্রমণপ্রিয় মানুষদের।
এখানে ঘুরতে আসা মানুষদের জন্যে ঘাটে রয়েছে স্পিটবোর্ড। কয়েকজন মিলে এক-দুই হাজার টাকা দিলেই প্রমত্তা পদ্মার বুকে ঘুরে নিয়ে আসবে। এছাড়াও ডিঙি ও ছোট ইঞ্জিন চালিত নৌকা রয়েছে। কয়েকশ টাকা ব্যয় করলে তারাও আপনাকে পদ্মার বুকে ঘুরে নিয়ে আসবে। এখানে বেড়াতে গিয়ে পদ্মা নদীর আসল মাছও কিনতে পারবেন।
এখানে আসলে সব বয়সীদের যেন প্রাণ জুড়ে যায়। তাই এখানে আবাসিক কোয়ার্টার, খেলার মাঠ, নিরাপত্তা ব্যবস্থাসহ কিছু অত্যাধুনিক অবকাঠামো নির্মাণ করলে এটি হতে পারে দেশের অন্যতম বিনোদন কেন্দ্রগুলোর অন্যতম।
পাকশীর রূপপুরের ৯০ বছর বয়সী শাহনেওয়াজ সরকার পাবনা বার্তা ২৪ ডটকমকে বলেন, স্থানীয় ও ইতিহাসবিদরা বলেন, ব্রিটিশদের আমলে এখানে আন্তর্জাতিক মানের ঘাট ছিল। দেশ-বিদেশ থেকে বড় বড় জাহাজ এখানে আসত। ওপাড়ে ভেড়ামারা এবং এপারে পাকশীতে বিশাল বাণিজ্য কেন্দ্র ছিল। দেশের বড় বড় ব্যবসায়ীরা এই ঘাট থেকে তাদের পণ্য আনা-নেয়া করতো। ব্রিটিশ সরকার ১৯ শতকের শুরু দিকে একটি সেতু নির্মাণের প্রয়োজনবোধ করল। এর ধারাবাহিকতায় ১৯১৫ সালে প্রায় ২৫ হাজার শ্রমিকের ঐকান্ত পরিশ্রমে ভরা যৌবনা পদ্মায় নির্মাণ করা হয় এই ব্রিজ। তাই সেই সময় থেকেই মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল ব্রিজটি। তখন থেকেই হাজার হাজার মানুষ এটি দেখতে আসতো।
পাকশীর বিবিসি বাজারস্থ বয়োবৃদ্ধ মুক্তার হোসেন পাবনা বার্তা ২৪ ডটকমকে জানান, ব্রিজটি নির্মাণের সময় থেকেই পাকশী ও এর আশপাশে পেপার মিল, বিমানবন্দর, সুগার মিল, ফুরফুরা শরীফ, ইপিজেডসহ ছোটখাট অনেক কলকারখানা, দোকানপাট ও বাজারঘাট গড়ে ওঠে। গোটা ভারতবর্ষে তেমন প্রভাব না পড়লেও পাকশীতে জনজীবনে ব্রিটিশ আধিপত্যের প্রভাব পড়েছিল। সেসময় স্থানীয় মানুষের জীবনযাত্রার মান পরিবর্তন হয়েছিল।
হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ও লালনশাহ সেতুর অপরূপ দৃশ্য এবং ইতিহাসে সমৃদ্ধ যুগল ব্রিজের স্থানটিতে একটি আন্তর্জাতিক মানুষের পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে পারলে সরকার যেমন রাজস্ব পেতে পারে ঠিক তেমনি মানুষ আরও গভীর মুগ্ধতায় পাকশীর অপরুপ সৌন্দর্যভোগ করতে পারতো বলে মনে করেন স্থানীয় সুশীল সমাজের ব্যক্তিবর্গ ও এখানে ঘুরতে আসা পর্যটকেরা।