এ যেন আরেক রিজেন্ট হাসপাতাল, আরেক জেকেজির কেলেঙ্কারি রুপ। রোগী কাছ থেকে করোনা ভাইরাসের নমুনা নিয়ে এখনও রাস্তায়, কিন্তু সেই নমুনার রিপোর্ট পৌঁছে গেল রোগীর কাছে। রিপোর্টে ফলাফল এসেছে নেগেটিভ।
চাঞ্চল্যকার এই ঘটনা ঘটেছে রাজধানীর গুলশানের একটি বেসরকারি হাসপাতালে।
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই রোগী জানান, তার নমুন পরীক্ষার জন্য বেসরকারি একটি নামি প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগাযোগ করেছিলেন। বাড়ি থেকে নমুনা সংগ্রহ করার জন্য একটি মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাপের মাধ্যমে অর্থ পরিশোধ করার পরের দিন নমুনা সংগ্রহের জন্য একজন আসেন।
গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, ‘বিকেল ৫টার দিকে এসে বাসা থেকে নমুনা নিয়ে গেল। ঠিক সাড়ে ৬টায় নেগেটিভ রিপোর্টের একটা মেসেজ এলো। আমি বেশ খুশি হয়ে আমার স্ত্রীর কাছে গেলাম। সে জানালো ওরা বলেছিল রিপোর্ট ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টা লাগবে।’
তবে রোগীর সন্দেহল হয় যে নমুনা সংগ্রহকারী ল্যাব পর্যন্ত পৌঁছানোর আগেই তার কাছে রিপোর্টের ফল চলে এসেছে। এজন্য তিনি যোগাযোগ করেন নমুনা সংগ্রহকারী হাসপাতালের সঙ্গে।
তিনি বলেন, ‘আমার স্ত্রী বিষয়টা আমাকে বলার পর আমি হাসপাতালের কল সেন্টারে ফোন করে বিষয়টা জানতে চাইলাম। আমাকে জানানো হল কোভিড-১৯ পরীক্ষাকে তারা অগ্রাধিকার দিচ্ছেন। আমার তবুও সন্দেহ হল। তখন আমি নমুনা সংগ্রহকারীকে ফোন দিয়ে জানলাম সে নমুনা নিয়ে এখনো ল্যাবে পৌঁছায়নি।’
তিনি প্রশ্ন করছেন, এমন ঘটনা কীভাবে ঘটতে পারে? তিনি সন্দেহ প্রকাশ করে বলছেন, বেসরকারি হাসপাতালগুলো কি আদৌ নমুনা পরীক্ষা করে কিনা।
‘আমার পরীক্ষার ফল কী – তার উপর নির্ভর করেই না আমি সিদ্ধান্ত নেবো। একটা ভুল ফলাফল অনেক কিছু বদলে দিতে পারে। বাংলাদেশের সবাই জানে না করোনা ভাইরাসের পরীক্ষা করতে কতদিন লাগে। পজিটিভ হওয়া পরও নেগেটিভ রেজাল্ট নিয়ে একজন ব্যক্তি অন্যদের আক্রান্ত করে বেড়াবে।’
শুধু এই ব্যক্তি নয়, করোনা নমুনার এই কেলেঙ্কারির ঘটনা থামছেই না। এর আগে এক জাপান প্রবাসীসহ দুই ব্যক্তি অভিযোগ করেছেন একই সময়ে তারা দুই জায়গায় করোনার নমুনা পরীক্ষা করেন। কিন্তু মাত্র একদিনের ব্যবধানে দুই জায়গায় দুই রকম (পজিটিভ/নেগেটিভ) আসে।
বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের পরীক্ষা শুরু হওয়ার প্রথম দিকেই বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বাংলাদেশে যে আরটিপিসিআর পদ্ধতিতে পরীক্ষা করা হয়, সেই পদ্ধতিতে পরীক্ষার ফলে অন্তত ৩০ শতাংশ পর্যন্ত ‘ফলস নেগেটিভ’ আসতে পারে।
অর্থাৎ নমুনায় করোনাভাইরাসের উপস্থিতি থাকলেও তা শনাক্ত না হওয়া। কিন্তু একজনের নমুনা পরীক্ষার ফল আরেকজনকে পাঠানো, নমুনা দেয়া ব্যক্তির তথ্য হারিয়ে ফেলা, দুই সপ্তাহ পার হওয়ার পরে পরীক্ষার ফল পাওয়া, দুই ল্যাবে পরীক্ষার দুই রকম ফল, ল্যাবে নমুনা পৌঁছানোর আগেই রিপোর্ট, এসব যে ‘ফলস নেগেটিভ’ নয় তা বোধহয় নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের পরিচালক তাহমিনা শিরিন বলেন, ‘নমুনা পরীক্ষার বেশ কয়েকটি ধাপ রয়েছে। নমুনা সঠিকভাবে সংগ্রহ করা, নির্ধারিত তাপমাত্রায় নমুনা সংরক্ষণ, সেই নমুনা সঠিকভাবে পরিবহন এবং মেশিনে পরীক্ষা। এর কোন একটা ধাপে সমস্যা হলে ভুল ফল আসতে পারে। হয়ত নমুনা নেয়ার জন্য যে পর্যন্ত ঢুকিয়ে ন্যাজাল সোয়াব নিতে হয় সেটা নেয়া হয়নি। সেরকম ঠাণ্ডা তাপমাত্রায় রাখার কথা সেটা হয়নি। কর্মীদের সক্ষমতাও একটা বড় ব্যাপার।’
তিনি বলেন, ‘ল্যাবের সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে। যে ল্যাব অল্প সময় হল পরীক্ষা শুরু করেছে তাদের গুছিয়ে ওঠার ক্ষেত্রে সময় লাগবে পারে। একটি নতুন টেকনিক অ্যাডাপ্ট করা, প্রশিক্ষিত কর্মী তারা পেয়েছে কিনা, পরীক্ষার জন্য যে রি-এজেন্ট দরকার হয় সেটার মান কেমন, হয়ত খরচ কমাতে নিম্নমানের রি-এজেন্ট ব্যবহার করা হয়েছে। অনেক রকমের ব্যাপার এখানে কাজ করে।’
তাহমিনা শিরিন জানান, বেসরকারি হাসপাতালগুলোর নমুনা পরীক্ষার ল্যাবগুলোর মান কেমন, সঠিকভাবে কাজ হচ্ছে কিনা সেব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে তাদের একটি প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছিল। আইডিসিআরের একটি দল বেশ কটি বেসরকারি হাসপাতাল পরিদর্শন করে একটি প্রতিবেদন স্বাস্থ্য অধিদফতরকে দিয়েছে।
তিনি আরও জানান, অনেক হাসপাতালে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নেই, কোথাও কাজের গতি যেমন হওয়া উচিৎ সেটি নেই, প্রশিক্ষিত কর্মী নেই, একই যন্ত্রপাতি বিভিন্ন যায়গায় ব্যবহৃত হচ্ছে। এসব হাসপাতালের ল্যাবে এরকম নানা রকম সমস্যা তারা দেখতে পেয়েছেন বলে তিনি জানিয়েছেন।
তবে এসব কেলেঙ্কারির মাঝে নমুনা পরীক্ষার মান পর্যবেক্ষণের দাবি বিশেষজ্ঞদের। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘যে কোনো মেডিকেল পরীক্ষার নির্ভুল ফল পাওয়ার জন্য মান নিয়ন্ত্রণ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমার জানা মতে করোনাভাইরাসের পরীক্ষার ক্ষেত্রে কোথায় কীভাবে মান নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে সেটি যাচাই করার মতো কোন ব্যবস্থা কোথাও নেই।’
তিনি বলেন, ‘নমুনা সংগ্রহ, সংরক্ষণ, পরিবহন এটি একটি চেইনের মতো। সেখানেও নজরদারি নেই। যন্ত্রে নমুনা লোড করা পর্যন্ত এই চেইন ঠিকমতো কাজ না করলে নির্ভুল পরীক্ষার হার কমে আসে। যন্ত্র পর্যন্ত যাওয়ার আগে যে ব্যবস্থা, সেখানেই সম্ভবত কোন ঘাটতি রয়েছে।’
করোনা ভাইরাসের নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা বাড়ানোর জন্য যে প্রচেষ্টা বাংলাদেশে দেখা গেছে, এর মান নিয়ন্ত্রণে সেরকম প্রচেষ্টা নেই বলে তিনি মনে করেন।
একদম শুরুতে শুধুমাত্র সরকারের আইইডিসিআরের ল্যাবে নমুনা পরীক্ষা করা হতো। এখন ল্যাবের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৯০টি। অনেক বেসরকারি হাসপাতালও এখন সরকার নির্ধারিত ফি’র বিনিময়ে নমুনা পরীক্ষা করছে। স্বভাবতই মনে হতে পারে, ছয় মাস পরে বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষার সক্ষমতা অনেক বাড়বে।
কিন্তু দেখা যাচ্ছে সরকারি ও বেসরকারি দুই ধরনের ল্যাব থেকেই নানা ভুলের ঘটনা ঘটছে। ছয়মাস পার হওয়ার পরও এরকম অনিয়ম কীভাবে ঘটছে?
করোনা সম্পর্কিত সরকারের গঠিত ক্লিনিকাল ম্যানেজমেন্ট কমিটি উপদেষ্টা ডা. এম এ ফয়েজ বলেন, পরীক্ষার কোন ধাপগুলো কীভাবে হবে, সকল ল্যাবকে একটি সেব্যাপারে একটি ‘স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসেডিওর’ দেয়া আছে। সেটা ঠিকমতো অনুসরণ করা না হলে ভুল হতে পারে। নমুনা অনেকবার হাত-বদল হয়, যে পদ্ধতিতে পরীক্ষা হচ্ছে তা বাংলাদেশ সহ সারা বিশ্বেই নতুন, কিছু কাজ মেশিনে, কিছু কাজ হাতে করতে হয়। পুরো প্রক্রিয়ার মেকানিজম আরও জোরদার করা দরকার। আমরা চাই না একটা পরীক্ষায়ও যেন গলদ না হয়।’
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করা হলেও আনুষ্ঠানিক কোন মন্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে অধিদফতরের একাধিক কর্মকর্তা সূত্র জানিয়েছে তারাও এধরনের অভিযোগ পেয়েছেন এবং পরীক্ষার মান নিয়ন্ত্রণে তারা ব্যবস্থা নিচ্ছেন।
ব্রেকিংনিউজ/ এসএ