রাষ্ট্র বিনির্মাণে প্রয়োজন দেশপ্রেমিক নেতা

অ্যাডভোকেট শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস

এক.
নিজের মেধা ও স্মৃতিশক্তি কাজে লাগিয়ে গোয়েবলস, চাণক্যের অনুসারীরা যুগে যুগে ছলেবলে কৌশলে দেশে দেশে দখল ও দুঃশাসন চালিয়েছে। একটি আধুনিক রাষ্ট্রে ন্যায়বিচার ও সুশাসন টিকিয়ে রাখতে যেমন সদা সতর্ক হয়ে কাজ করতে হবে, তেমনি একটু অসতর্কতার সুযোগে দুঃশাসন আবারো ফিরে আসতে পারে।

আমরা দেখছি, বাংলাদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, আদালত, শিক্ষাব্যবস্থা, সামাজিক স্থিতিশীলতা ও ক্ষমতার ভারসাম্য নিরেট মিথ্যার ওপর নির্ভরশীল করে রাখা হয়েছে। ফলে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ও প্রশাসনিক কাঠামোর সর্বত্র নৈতিক অবক্ষয় প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের এই অবক্ষয় রোধ করতে না পারলে দেশের ভয়াবহ সর্বনাশ এড়ানো অসম্ভব হতে পারে। সর্বনাশ যে হয়নি তাও বলা যাবে না, উপরন্তু সর্বনাশ এখন সর্বগ্রাসী রূপ নিয়েছে।

রাষ্ট্র ও সরকারের প্রতিটি সেক্টরে এখন নেতৃত্ব দিচ্ছে অযোগ্য, দুর্নীতিবাজ ও ব্যক্তিস্বার্থে অন্ধ একদল মানুষ। রাজনীতি এখন অর্থ কামানোর একটি লাভজনক ব্যবসায় মনে করে একশ্রেণীর মানুষ। সামাজিক এই অবক্ষয় হঠাৎ করে চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত হয়নি। এর থেকে মুক্তির জন্য প্রয়োজন দৃঢ়চেতা ও দেশপ্রেমিক ভালো মানুষের নেতৃত্ব। সেই নেতৃত্ব এখন রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানেই প্রয়োজন। তবে সবার আগে প্রয়োজন শিক্ষাঙ্গন, আদালত, জনপ্রশাসন, ব্যাংক খাত, পুলিশসহ গোটা প্রশাসন আর সেই সাথে বিচার বিভাগের আমূল সংস্কার। মানুষ যখন নৈতিকভাবে দেউলিয়া থাকে তখন আইন অর্থহীন। একটি সুস্থ স্বাভাবিক সমাজ বিনির্মাণে ভালো মানুষ লাগবেই। রাজনীতিক প্রক্রিয়ায় এই বাস্তবতা আরো বেশি।

দুই.
ইতিহাসের আলোকে উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক যে, ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারত উপমহাদেশে তাদের সাম্রাজ্যবাদী শাসন ও দখল প্রতিষ্ঠার জন্য ১৭৫৭ সালে নবাব সিরাজ উদ্দৌলাকে ছলনা এবং চক্রান্তের মাধ্যমে পরাজিত ও হত্যা করে। এরপর ইংরেজরা তাদের দখল টিকিয়ে রাখার কৌশল হিসেবে ভারতব্যাপী মানুষের নৈতিক শক্তি ধ্বংস করতে এবং সম্প্রীতি বিনষ্ট করতে এক ঘৃণিত পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছিল। বিভেদ ও অনৈক্যের মাধ্যমে ভারতীয়দের নৈতিক শক্তি ধ্বংস করতে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির সময় লেগেছিল প্রায় ৭৫ বছর। ইংরেজরা ছল, বল ও কৌশলের মাধ্যমে পরিকল্পিতভাবে ভারতে হিংসা, বিদ্বেষ সঙ্ঘাত ছড়িয়ে দিয়েছিল। সঙ্ঘাত ও বিভেদ তৈরি করে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত তাদের শাসন দীর্ঘায়িত করতে পেরেছিল। ব্রিটিশের ছলনা, বিভেদ ও অনৈক্যের ফাঁদে পড়ে ভারতবাসী নিজেদের ঐক্য ও নৈতিক শক্তি হারিয়ে ফেলে। ফলে স্বাধীনতা অর্জন করতে উপমহাদেশের মানুষের পৌনে ২০০ বছর সময় লেগেছিল।

তিন.
দেশী ও বিদেশী কায়েমি শক্তি বাংলাদেশে পরিকল্পিতভাবে সন্ত্রাস ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি তথাকথিত ওয়ান-ইলেভেনের ক্যু ঘটায়। বাংলাদেশের শাসনক্ষমতা চলে যায় একটি অস্বাভাবিক সরকারের হাতে। সামনে সিভিল কিন্তু পেছনে উর্দি শাসনে পরে বাংলাদেশ। সেখান থেকে আজো বেরিয়ে আসা সম্ভব হলো না। এক-এগারোর চক্রান্তের ফলাফল আজকের দুর্যোগপূর্ণ বাংলাদেশ। এক-এগারোর চক্রান্তের মাধ্যমে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা কাঠামোর বিভিন্ন অংশে যে বিদেশী শক্তির অনুচররা অনুপ্রবেশ করে, তারা এখন পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে নগ্নভাবে অপব্যবহার করছে। এক-এগারোর সাথে জড়িত দেশী ও বিদেশী শক্তির প্রত্যক্ষ পরিকল্পনা মোতাবেক ২০০৮ সালে পাতানো ভোটের মাধ্যমে বাংলাদেশে চরম দুর্নীতিগ্রস্ত একটি সরকারকে ক্ষমতায় বসানো হয়। জেনেভা কনভেনশনের রীতিনীতি অগ্রাহ্য করে বহিঃশক্তি আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসাতে ২০০৭ সালে বাংলাদেশে এক-এগারোর ক্যু’দেতা ঘটায়। ফলে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক শাসন ও নিরপেক্ষ ভোট ব্যবস্থার অপমৃত্যু ঘটে। ভোটারবিহীন গণতন্ত্রের চূড়ান্ত ফলাফল ভোগ করছে আজ বাংলাদেশের জনগণ। জুলুম ও দুঃশাসনের মাধ্যমে চূড়ান্ত বিপর্যয়ের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ।

আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসানোর ফলে বাংলাদেশে এক নিকৃষ্ট ফ্যাসিবাদ কায়েম করেছে। ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি না থাকায় দেশে সীমাহীন দুর্নীতির বিস্তার ঘটেছে। অনিয়ম ও অরাজকতার মাধ্যমে গত ১৫ বছরে বাংলাদেশ দুর্নীতির স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে। সুশাসন ও গণতন্ত্রের দাবিতে বিরোধী দলের চলমান রাজনৈতিক আন্দোলন দমনে সরকারের নিষ্ঠুর নিপীড়নের কাহিনী এখন বিশ্বজুড়ে আলোচিত।

চার.
দেশের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি দেখে স্পষ্ট বোঝা যায়, যেকোনো সময় বৈতরণী উল্টে যেতে পারে। বিরাজমান এই সঙ্কটজনক পরিস্থিতিতে দেশরক্ষা ও মানুষ বাঁচানোর জন্য অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ও ঘৃণা প্রকাশের সাথে সাথে এখন সবাইকে ন্যায়ের পথ অনুসরণে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে। সব ধরনের অনিয়ম রুখে দিতে হবে।

একটি আধুনিক কল্যাণরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়ার এখনই সময়। নিজে সৎপথে চলব এবং প্রতিবেশীদের এ বিষয়ে সহায়তা করব, ব্যক্তি জীবনে এই মূল্যবোধ চর্চার সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

পাঁচ.
মুসলিম শাসকদের কাছ থেকে ভারতের শাসনক্ষমতা কেড়ে নিয়ে ভারতীয়দের চুরি করা, মিথ্যা বলা, ভিক্ষাবৃত্তি করা, দুধে পানি মেশানো, খাদ্যে ভেজাল এবং ওজনে কম বেশি করা রপ্ত করাতে ব্রিটিশদের ৭৫ বছর সময় লেগেছিল। অথচ স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরও উপমহাদেশের (ভারত-পাকিস্তান, বাংলাদেশসহ) ২০০ কোটি মানুষ তাদের হারানো নৈতিক শক্তি আজো পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে পারেনি।

এ কথা সত্যি, স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা অনেক কঠিন। সে জন্য স্বাধীনতা প্রিয় বাংলাদেশের জনগণকে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার সংগ্রামে দৃঢ়ভাবে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে। নীতি-নৈতিকতাবিবর্জিত মানুষ কোনো মানুষকেই নেতৃত্ব দেয়ার অধিকার রাখে না। প্রায় ২০০ বছরের ব্রিটিশ শাসনে আমাদের সমাজের যে নৈতিক অবক্ষয় হয়েছে তার প্রভাব আজো রয়ে গেছে। একটি সুন্দর সমাজ ও রাষ্ট্র বিনির্মাণে নৈতিকভাবে শক্তিশালী একদল মানুষ প্রয়োজন যারা রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান ভেঙেচুরে নতুন করে গড়ে তুলবে।

লেখক : বিএনপি চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী

error: কাজ হবি নানে ভাই। কপি-টপি বন্ধ