দীর্ঘ একমাসের অধীক সময় শূন্য থাকার পর পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (পাবিপ্রবি) নতুন উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. হাফিজা খাতুনকে। মঙ্গলবার (১২ এপ্রিল) তাকে এ পদে নিয়োগ দেওয়া দেন রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ। ড. হাফিজা খাতুন পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম নারী উপাচার্য। এক নজরে দেখে নেয়া যাক ড. হাফিজা খাতুনের জীবনবৃত্তান্ত।
হাফিজা খাতুন একজন বাংলাদেশি শিক্ষাবিদ ও অধ্যাপক। তিনি গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীনে নগর উন্নয়ন অধিদপ্তরে গবেষণা কর্মকর্তা হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন, পরে ১৯৮৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগে (বর্তমানে ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ) প্রভাষক হিসাবে যোগদান করেন। তার ৯ টি বই, ৮০ টিরও বেশি গবেষণাকর্ম যা বিভিন্ন বইয়ের অধ্যায় হিসাবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জার্নাল ও অন্যান্য জায়গায় প্রকাশিত হয়েছে। ২০২২ সালের ১২ এপ্রিল তাকে পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়।
শিক্ষা, প্রারম্ভিক ও ব্যক্তিগত জীবন
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের প্রথম ব্যাচের ছাত্রী ও ক্রীড়াবিদ হাফিজা খাতুনের জন্ম ১২ জুলাই ১৯৫৪ সালে। পুরাতন ঢাকার ধোলাই খালের তীরে, বংশাল এলাকায় হাফিজা খাতুনের জন্ম ও বেড়ে উঠা। মওলানা কবিরউদ্দিন রহমানী এবং বেগম ফয়জুন্নেসার দশ ছেলেমেয়ের মধ্যে হাফিজার অবস্থান সপ্তম এবং মেয়েদের মধ্যে চতুর্থ ।
উনার মা বেগম ফয়জুন্নেসাও একটি শিক্ষিত পরিবারের সদস্য ছিলেন এবং শিক্ষা গ্রহণ করেছেন উনার মা অর্থাৎ হাফিজার নানী নজিবুন্নেসার কাছে । নজিবুন্নেসা ১৯২১ সালে মেয়েদের জন্য একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, রুপগঞ্জের মাসুমাবাদ গ্রামের কাজী বাড়ীতে। এটি পরবর্তীতে নারায়ণগঞ্জ জেলার, রুপগঞ্জ ঊপজেলার ৬১ মাসুমাবাদ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় হিসাবে পরিচিতি লাভ করে।
হাফিজা খাতুন ফার্স্ট ক্যাপিটাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের (এফসিইউবি) উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. হযরত আলীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। অধ্যাপক আলী শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শেকৃবি) কোষাধ্যক্ষ ও কৃষিতত্ত্ব বিভাগের সভাপতি ছিলেন। এই দম্পতির রয়েছে তিন সন্তান এবং ছয়জন নাতি – নাতনী। তাদের প্রথম কন্যা তানিয়া এ আলী, দ্বিতীয়জন ড. তনিমা এস আলী এবং একমাত্র ছেলে ক্যাপ্টেন তাহসিন ই আলী (অব.) বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন।
হাফিজা খাতুন ছাড়াও উনার দুই বোন এবং দুই ভাগিনা বাংলাদেশের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্যমান্য ব্যক্তি। তারা হলেন: অধ্যাপক ডঃ হাবিবা খাতুন , অধ্যাপক এবং প্রাক্তন, বিভাগীয় প্রধান ,ইসলামী ইতিহাস ও সংস্কৃতি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় । অধ্যাপক ডা. লতিফা সামসুদ্দিন , অধ্যাপক এবং প্রাক্তন, বিভাগীয় প্রধান ,OB-GYN , বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়। মেজর জেনারেল আতাউল হাকিম সারওয়ার হাসান- উপাচার্য, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি)। এ.এইচ. লুতফুল হাসান, রেজিস্টার , নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় , বাংলাদেশ ।
হাফিজা খাতুন তার প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেছেন পুরাতন ঢাকার মালীটোলা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে, মাধ্যমিক শিক্ষা কামরুন্নেসা সরকারী মহিলা বিদ্যালয় (বর্তমানে কামরুন্নেসা সরকারী মহিলা উচ্চ বিদ্যালয় ) এবং উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ করেছেন ঢাকা সরকারী মহিলা বিদ্যালয় (বর্তমানে বেগম বদরুন্নেসা সরকারী মহিলা বিদ্যালয়) থেকে ।
হাফিজা খাতুন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রীড়াবিদ এবং প্রথম মহিলা ব্লু (Blue)১৯৭৩:
হাফিজা খাতুন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের প্রথম ব্যাচের একজন ছাত্রী । তিনিই প্রথম যিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় তথা ভূগোল বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী্ যে কিনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষদ হিসাবে নিযুক্ত হন।
তিনি বি এ (সম্মান) (১৯৭৬) এবং এম এ (১৯৭৭) (ভূগোল) ডিগ্রী গ্রহণ করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে । তিনি কমনওয়েলথ বৃত্তি নিয়ে কানাডার আলবার্টা বিশ্ববিদ্যালয়ে যান এবং সেখান থেকে নগর ও সামাজিক ভূগোলে ১৯৮৪ সনে আরেকটি এম এ ডিগ্রী লাভ করেন ।তিনি পি এইচ ডি করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে (নৃ ভূগোল) ১৯৯৮ সনে এবং এ সময়ে উনি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (বাংলাদেশ) এর ফেলোশীপ লাভ করেন। তিনি ১৯৮১ সালে নগর উন্নয়ন ও গৃহায়নের উপর একটি স্বল্পমেয়াদী কোর্স করেন ব্যাংককের AIT থেকে এবং ১৯৭৮ সালে UNICEF নেপাল থেকে উন্নয়ন প্রকল্পের উপর আরেকটি কোর্স করেন।
কর্ম জীবন
হাফিজা খাতুনের ৪০ বছরের ও বেশি সময় ধরে শিক্ষকতা এবং গবেষণার অভিজ্ঞতা রয়েছে । তিনি ১৯৭৯ সালে গৃহায়ন ও গ্ণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীনে নগর উন্নয়ন অধিদপ্তরে গবেষণা কর্মকর্তা হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেছেন। তার দ্বিতীয় কর্মজীবন শুরু করেছেন কুমুদিনী কলেজ এবং ইডেন মহিলা কলেজ্, সেখানে তিনি ১৯৮১-১৯৮৬ সাল পর্যন্ত ভূগোল বিভাগের প্রভাষক হিসাবে কাজ করেছেন। তিনি ১৯৮৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসাবে যোগদান করেছেন এবং ধীরে ধীরে সহকারী অধ্যাপক , সহযোগী অধ্যাপক এবং অধ্যাপক পদে ন্যাস্ত হন । তিনি জুন ২০১৫ থেকে জুন ২০১৮ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ গবেষণা প্রশিক্ষন কেন্দ্রের (DRTMC) এর পরিচালক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন । অনুষদ সদস্যর পাশাপাশি উন্নয়নের অংশীদার ( সামাজিক সুরক্ষা বিশেষজ্ঞ) হিসাবে , দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ এবং উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ হিসাবে তিনি নীতি নির্ধারণের অনেক সিদ্ধান্ত এবং উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে অবদান রেখেছেন । অধ্যাপক হাফিজা খাতুন ২০১৯ সাল থেকে চীনের নানজিং এর হোহাই বিশ্ববিদ্যালয়ের পুনর্বাসন জাতীয় গবেষণা কেন্দ্রের (NRCR) একাডেমিক উপদেষ্টা কমিটির (AAC) সদস্য।
ডঃ হাফিজা ২০১৯ সাল থেকে চীনের নানজিং এর হোহাই বিশ্ববিদ্যালয়ের পুনর্বাসন জাতীয় গবেষণা কেন্দ্রের (NRCR) একাডেমিক উপদেষ্টা কমিটির (AAC) সদস্য।
জার্নালের সম্পাদক
ডঃ হাফিজা অনেক জার্নালের সম্পাদক, যার মাত্র কয়েকটি দেয়া হলো- Journal of the Asiatic Society of Bangladesh , Science; Dhaka University Journal of Earth and Environment Sciences; Oriental Geographer, BGS; ভূগোল ও পরিবেশ জার্নাল; Protibesh, Journal of the Department of Architecture , BUET (সম্পাদকীয় বোর্ড সদস্য )
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়তা
হাফিজা খাতুন (শীর্ষ ডান) তার মায়ের সাথে (বেগম ফয়জুন্নেসা কবিরউদ্দিন), ছোট ভাই (আবু মনজুর মোরশেদ), বড় ভাই (আবু রায়হান মাহমুদ [সেক্টর ৩ এর মুক্তিযোদ্ধা]), ছোট বোন (হামিদা শিরিন), বড় বোন (অধ্যাপক হাবিবা খাতুন) এবং ভাগ্নে / ভাগ্নি গন।
হাফিজা খাতুন ১৯৭১ সালে তার ভাই আবুল হাসান মাসুদের সেক্টর -৩ এর অধীনে সিলেট ফ্রন্টে সম্মুখ যুদ্ধে লড়াই করেছেন এবং আবুল হাসান মাসুদ সেক্টর -২ এর আওতাধীন ঢাকা মহানগরীর কোতয়ালী থানা বংশাল অঞ্চলের গেরিলা কমান্ডার ছিলেন। তার পৈতৃক নিবাস ‘৩৭, হাজী আবদুল্লাহ সরকার লেন বংশাল ছিল (মাসুদ বাহিনীর) গেরিলা ইউনিটের কেন্দ্র। তিনি ও তার অন্যান্য ভাইবোনেরা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য খাবার, ঔষধ সরবরাহ, প্রাথমিক চিকিৎসা , বার্তা প্রেরণ, তাদের লুকিয়ে রাখা এবং এক জায়গা থেকে অন্য জায়গয় অস্ত্র বহন করা ইত্যাদি কাজে জড়িত ছিলেন।
কল্যাণ তহবিল
অধ্যাপক হাফিজা বিভিন্ন গবেষণা এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঁচটি ট্রাস্ট ফান্ড প্রতিষ্ঠার সাথে জড়িত । দুটি ট্রাস্ট ফান্ড উনার পিতা মাতার নামে “ফয়জুন্নেসা কবিরউদ্দিন রহমানী মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশন ’ তিনি তার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে গঠন করেছেন বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি এবং গাজীপুরের বড় কয়ের বিদ্যালয়ে । বাকী দুটো রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগে । এই তহবিল ভালো ফলাফলের জন্য বৃত্তি ও স্বর্ণপদক প্রদান করে। তিনি একই উদ্দেশ্য নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগে “ হাফিজা খাতুন স্বর্ণপদক ট্রাস্ট ফান্ড “ নামে আরেকটি তহবিল গঠন করেছেন।
গবেষণা
হাফিজা খাতুনের ৪০ বছরের ও বেশি সময় ধরে গবেষণা পরিচালনার অভিজ্ঞতা রয়েছে । ৭০ টির ও বেশি স্নাতকোত্তর স্তরের শিক্ষার্থীদের গবেষণা পরিচালনায় তদারকি করেছেন। তিনি সামাজিক সুরক্ষা বিশেষজ্ঞ এবং ভূমি অধিগ্রহণ, উন্নয়ন কার্যক্রম , বাংলাদেশের পুনর্বাসন সংক্রান্ত সমস্যা সমপর্কিত নীতি এবং পরিকল্পনায় আন্তর্জাতিক পর্যায়েও অবদান রেখেছেন।