আজ ‘পাবনা মুক্ত দিবস’

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর পাক সেনারা পাবনা দখলের চেষ্টা চালালে প্রতিরোধ যুদ্ধে নামে পুলিশ ও সাধারণ জনতা। ২৭ থেকে ৩০ মার্চ তুমুল প্রতিরোধ যুদ্ধে নিহত হন পাকসেনারা। নয় মাসের যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা তাদের বিরুদ্ধে ত্রিমুখী আক্রমণ চালায়।

দুই দিন একটানা তুমুল যুদ্ধের পর হানাদার বাহিনী পালিয়ে গেলে ১৮ ডিসেম্বর পাবনা শত্রুমুক্ত হয়। শহীদ ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ধরে রাখতে ১৯৯৮ সালে কালেক্টরেট ভবনের সামনে নির্মাণ করা হয় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিসৌধ ‘দুর্জয় পাবনা’।

এক মুক্তিযোদ্ধারা জানান, পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর সারা দেশে বিজয়োল্লাস শুরু হলেও পাবনায় তখনো ঢুকতে পারেননি মুক্তিযোদ্ধারা। সারা দেশের মানুষ যখন বিজয়ের আনন্দে ভাসছে, তখনো পাবনার দখল ছাড়েনি পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। মুক্তিযোদ্ধারা যেন ঢুকতে না পারেন, সে জন্য জেলার বিভিন্ন রাস্তা অবরোধ করে রাখে তারা। ২ দিন পর পর্যন্ত আত্মসমর্পণ করেনি পাবনায় অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনারা।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বিভিন্ন স্থান থেকে মুক্তিযোদ্ধারা নিজ জেলা পাবনায় ঢুকে পড়লেও শহরে প্রবেশ করতে পারিনি। পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্যরা পাবনা শহরের ওয়াপদা এবং জেলার ঈশ্বরদীতে অবস্থান নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবেশে বাধা দেয়। এ সময় তারা বিভিন্ন স্থানে গাছের গুঁড়ি ফেলে রাস্তা অবরোধ করে রাখে।

আত্মসমর্পণের জন্য বার বার তাগিদ দিলেও পাকিস্তানি সেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করেনি। অবশেষে ১৮ ডিসেম্বর ভারতীয় সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন নান্দা পাবনায় আসেন। পাকিস্তানি বাহিনী তার কাছে আত্মসমর্পণ করে। পরে মুক্তিযোদ্ধারা শহরে ঢুকে পাবনা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়িয়ে পাবনা মুক্ত ঘোষণা করেন।

তখন থেকে প্রতি বছর ১৮ ডিসেম্বর পাবনা মুক্ত দিবস হিসেবে পালন করা হয়।

মুক্তিযোদ্ধারা জানান, যুদ্ধের শুরুতে পাবনায় সাধারণ জনতা প্রতিরোধ গড়ে প্রথম দফায় জেলায় আসা প্রায় সব পাকিস্তানি সেনাদের হত্যা করে। এ সময় প্রায় ১০ দিন শত্রুমুক্ত থাকে পাবনা। এরপর নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি করে পাকিস্তানি সেনারা ১০ এপ্রিল আবার পাবনায় প্রবেশ করে। তারপর থেকে শুরু হয় নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। মহান মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস পুরো জেলাজুড়ে নারকীয় গণহত্যা চালায় পাকিস্তানি সেনারা।

জেলার প্রায় প্রতিটি গ্রামে আছে পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরতা আর গণহত্যার ভয়াবহতার চিহ্ন। প্রতিশোধের ভয়ে পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করেনি বলেও মনে করেন অনেকেই।

জেলার মুক্তিযোদ্ধাদের মতে, ২৯ মার্চ সংঘটিত প্রতিরোধ যুদ্ধের অভিজ্ঞতা থেকেই স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করার সাহস পায়নি পরাজিত পাকিস্তানি সেনারা।

২৭ মার্চ হাজার হাজার মুক্তিকামী জনতা লাঠি, দা, বটি এবং লাইসেন্স করা কয়েকটি বন্দুক নিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের তৎকালীন ঘাঁটি পাবনা টেলিফোন এক্সচেঞ্জ ভবনের চারদিকে ঘিরে ফেলে। পাকিস্তানি সেনারা গুলিবর্ষণ করতে থাকলেও পিছু হটেনি সাধারণ মানুষ। ২ দিন ধরে চলা যুদ্ধে অবশেষে পরাজিত হয় পাকিস্তানি সেনারা, নিহত হয় তাদের সবাই। ২৯ মার্চ থেকে ১০ এপ্রিল পর্যন্ত পাকিস্তানি সেনা মুক্ত থাকে পাবনা।

তবে ১০ এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্যরা শক্তি বৃদ্ধি করে পাবনায় প্রবেশ করে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালায়। যার চিহ্ন আছে নগরবাড়ি, সাগরকান্দি, সাতবাড়িয়া, ডেমরা, হাদল, গোপালনগর ও হান্দিয়ালসহ জেলার বিভিন্ন এলাকায়।

৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধে ঠিক কতজন মানুষকে তারা হত্যা করেছে তার সঠিক তথ্য না থাকলেও গণহত্যার প্রতিটি চিহ্ন মনে করিয়ে দেয় পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মমতার ইতিহাস।

ফরিদপুর উপজেলার ডেমরা গণহত্যা জেলার অন্যতম বৃহত্তম গণহত্যা। পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্যরা এক রাতে এখানে প্রায় ৯ শতাধিক মানুষকে হত্যা করে, জ্বালিয়ে দেয় ঘরবাড়ি, নারীদের ওপর চালায় পৈশাচিক নির্যাতন।

সাতবাড়িয়া, হাদল এলাকায় এক রাতে শত শত মানুষকে হত্যা করা হয়।

গত ২৯ মার্চের পরাজয়ের স্মৃতি এবং ৯ মাস ধরে চালানো গণহত্যার কারণে প্রতিশোধ হামলার ভয়ে পাকিস্তানি সেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণের সাহস পায়নি। ১৬ ডিসেম্বরের পর পাকিস্তানি সেনারা প্রতিরোধ তৈরি করলেও মুক্তিযোদ্ধারা ধৈর্য ধারণ করেন। অবশেষে ১৮ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনাদের আত্মসমর্পণের পর স্বাধীন বাংলার বিজয়ের পতাকা ওড়ানো হয়।

পাবনা মুক্ত দিবস উপলক্ষে প্রতি বছরের মতো এ বছরও জেলার বিভিন্ন সংগঠনের বিভিন্ন কর্মসূচি আছে।

error: কাজ হবি নানে ভাই। কপি-টপি বন্ধ