অবশেষে আওয়ামী লীগে যোগ দিলেন পাবনার মেয়র মিন্টু

নানা জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে পাবনা পৌরসভার মেয়র ও জেলা বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক কামরুল হাসান মিন্টু আওয়ামী লীগে যোগদান করেছেন। এসময় বিএনপি নেতা ও পৌরসভার প্যানেল মেয়র ফরিদুল ইসলাম ডালুসহ ১৫ জন বিএনপিপন্থি কাউন্সিলরও আওয়ামী লীগে যোগদান করেন।

রবিবার (২৩ ফেব্রুয়ারি) রাতে ঢাকার ধানমন্ডি কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে তারা আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। যোগদান কালে ফুলেল শুভেচ্ছাসহ তাকে বরণ করেন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম ও জাহাঙ্গীর কবীর নানক।

এসময় কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের আরও অনেক নেতাসহ সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এ্যাড. শামসুল হক টুকু এমপি, পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও পাবনা-৫ আসনের সাংসদ গোলাম ফারুক প্রিন্স, পাবনা-২ আসনের সাংসদ আহমেদ ফিরোজ কবীর, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সাবেক দুদক কমিশনার বীর মুক্তিযোদ্ধা সাহাবুদ্দিন চুপ্পু, পাবনা সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আলহাজ্ব মোশারফ হোসেন উপস্থিত ছিলেন।

যোগদান অনুষ্ঠানে ওবায়দুল কাদের বলেন, আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে কামরুল হাসান মিন্টুকে আওয়ামী লীগে যোগদান করানো হলো।

পাবনা পৌরসভার পর পর তিন বারের নির্বাচিত মেয়র কামরুল হাসান মিন্টু পাবনা জেলা বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। জেলা বিএনপির একটি গ্রুপের নেতৃত্ব দিতেন তিনি। যা বিএনপিতে মিন্টু গ্রুপ বলে পরিচিত ছিল।

তথ্যমতে, কামরুল হাসান মিন্টু পাবনা সরকারি এডওয়ার্ড কলেজে ছাত্রাবস্থায় কলেজ সংসদের ভিপি ও জিএস নির্বাচিত হন। তৎকালীন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম বকুল বিএনপিতে যোগদান করলে তার সাথেই দল পরিবর্তন করে বিএনপির রাজনীতিতে প্রবেশ করেন কামরুল হাসান মিন্টু। গেল দুই যুগ সময়কালে বিভিন্ন পদসহ জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। জেলার বিএনপির রাজনীতিতে শিমুল বিশ্বাস ও কামরুল হাসান মিন্টু সমর্থিত দুইটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে যায়।

১/১১’র সময় সংস্কারপন্থিদের দলে ভেড়েন তৎকালীন পাবনা জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও পৌরসভার মেয়র কামরুল হাসান মিন্টু। ফলে ২০০৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি সংস্কারপন্থি হিসেবে বহিষ্কার হোন মিন্টু।

২০০৯ সালের জুনে জেলা বিএনপির কমিটি বিলুপ্ত করে জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমানকে আহ্বায়ক করে ৭১ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়। পরে ২০১২ সালে কেএস মাহমুদকে সভাপতি ও হাবিবুর রহমান তোতাকে সাধারণ সম্পাদক করে ১৭২ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি করা হয়। এই কমিটি ভেঙ্গে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে হাবিবুর রহমান হাবিবকে আহবায়ক করে আহবায়ক কমিটি গঠন করা হয়েছে।

এসব কমিটি থেকে বাদ পড়েন মিন্টু। ২০১২ সালে কমিটতে স্থান না পেয়ে নিজেদের বিএনপির ত্যাগী নেতাকর্মী দাবি করে তৈরি করেন ‘পাবনা জেলা বিএনপি রক্ষা কমিটি’। এই বিএনপি রক্ষা কমিটির নিয়ন্ত্রণে ছিলেন সাবেক জেলা সভাপতি সিরাজুল ইসলাম সরদার ও কামরুল ইসলাম।

মূলত বিএনপি রক্ষা কমিটির কার্যক্রম চলে মেয়র কামরুল হাসান মিন্টুকে ঘিরে। আর মুল অংশের নেতৃত্ব চলে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বিশেষ সহকারী অ্যডভোকেট শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাসের নেতৃত্বে।

মূলত এই শিমুল বিশ্বাস-কামরুল হাসান মিন্টুকে কেন্দ্র করে পাবনা বিএনপির নেতাকর্মীরা এখন দুই ভাগে বিভক্ত। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে, মুখ দেখাদেখি পর্যন্ত নেই দুই পক্ষের নেতাকর্মীদের মধ্যে। ফলে দীর্ঘ সময় ধরেই পাবনাতে বিএনপি’র রাজনীতিতে টানাপোড়েন শুরু হয়। জেলা, উপজেলা, পৌরসভা, ইউনিয়ন এমনকি ওয়ার্ড পর্যায়ে বিএনপি দুটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পড়ে।

জানা গেছে, ২০১৬ সালে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে কামরুল হাসান মিন্টু পাবনা পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হন। এর আগেও পরপর দু’বারের নির্বাচিত মেয়র মিন্টু। ১৯৯৩ সালে তৎকালের সর্বস্তরের জনপ্রিয় নেতা খ্যাত, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম বকুলের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের অর্ধেক অংশই বিএনপির রাজনীতিতে যোগদান করেন। সে সময়ে ওই দলে কামরুল হাসান মিন্টুও ছিলেন। বিএনপির রাজনীতিতে যোগদানের পর দক্ষ সংগঠক রফিকুল ইসলাম বকুলের হাত ধরেই এ জেলায় বিএনপির রাজনীতি চাঙা হয়ে উঠে।

সূত্র জানায়, বাম রাজনীতি ছেড়ে ১৯৯৯ সালে বিএনপিতে যোগদান করেন অ্যাডভোকেট শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস। বিএনপির রাজনীতিতে শিমুল বিশ্বাস নবাগত হলেও ঢাকায় বিএনপি চেয়ারপারসনের খুব আস্থাভাজন হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। আর তাকে কেন্দ্র করেই পাবনা বিএনপিতে দেখা দেয় পক্ষ-বিপক্ষের হিসেব কষা।

কামরুল হাসান মিন্টু আওয়ামী লীগের যোগদান করছেন এমন খবর বেশ কিছুদিন ধরেই পাবনায় বেশ আলোচিত খবরে পরিণত হয়েছে। নানা শ্রেণি পেশার মানুষের মুখে মুখে রব পড়ে যায়। তারই ফলাফল রবিবার কামরুল হাসান মিন্টুর আওয়ামী লীগের যোগদানের পর ধোয়াশা কেটেছে বলে শহরের একাধিক জনের মন্তব্য।

যোগদান অনুষ্ঠানে যোগদানকারী ও উপস্থিত গণমাধ্যমে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, যোগদানকারীদের দলের পক্ষ থেকে স্বাগত ও শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। পাশাপাশি আপনারা দল করলে অবশ্যই দলের নিয়ম কানুন মেনে চলবেন। তিনি আরও বলেন, মাদক বিক্রেতা, ভূমিদস্যু বা দখলকারী, চিহ্নিত চাঁদাবাজ, যুদ্ধাপরাধী ও স্বাধীনতাবিরোধী চক্র এ ধরনের কোন মানুষকে আমরা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়াতে চাই না।

যোগদানের পর কামরুল হাসান মিন্টু বলেন, আমি এখনও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ থেকে বিন্দুমাত্র বিচ্যুত হইনি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাকে সন্তানের দৃষ্টিকোণ থেকে নিজগুনে ক্ষমা করেছেন। আবারও তার সন্তানকে তার কাছেই টেনে নিলেন। এ জন্য আমি ব্যক্তিগতভাবে ও পাবনাবাসীর তরফ থেকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। তিনি আমাকে তার কাছে আরও ঋণী করে দিলেন এমন দাবি মিন্টুর। এদিকে কামরুল হাসান মিন্টু পাবনার সাংবাদিকদের এক প্রতিক্রিয়ায় মুঠোফোনে জানান, আওয়ামী লীগ আমার আঁতুর ঘর। ঘর থেকে বাহিরে ছিলাম। আবার নিজ ঘরেই ফিরে এসেছি।

এ বিষয়ে পাবনা সদর আসনের সংসদ সদস্য, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম ফারুক প্রিন্স বলেন, মিন্টু জন্মগত আওয়ামী লীগের ঘরের সন্তান। সে বঙ্গবন্ধুর আর্দশে অনুপ্রাণিত সৈনিক। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধ তার মধ্যে ছিল এবং আছে।

আর সাবেক সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট শামসুল হক টুকু এমপি বলেন, আওয়ামীলীগ ঘরনার নেতাকর্মীদের সঙ্গে কামরুল হাসান মিন্টুর সম্পর্কচ্ছেদ হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাগ্রত করার লক্ষ্যেই ঘরের ছেলে আবার ঘরে ফিরে এসেছেন।

তবে পাবনার স্থানীয় একাধিক নানা শ্রেণির মানুষের সাথে আলাপকালে তারা বলেন, আগামীতে পাবনায় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ হতে যাচ্ছে। কামরুল হাসান মিন্টুর আওয়ামী লীগের যোগদানে এটি ক্রমাগত স্পষ্ট হতে চলেছে বলে তারা মত প্রকাশ করেন।

error: কাজ হবি নানে ভাই। কপি-টপি বন্ধ